মাছ চাষের জন্য আদর্শ পুকুর তৈরি করবেন যেভাবে

830

এখন অনেকেই মাছ চাষে ঝুঁকছেন। তবে কেউ কেউ মাছ চাষে আশানুরূপ সফলতা পাচ্ছেন না। মাছ চাষে আশানুরূপ সফলতা পেতে হলে আগে আদর্শ পুকুর বা জলাশয় তৈরি করতে হবে। পুকুর হচ্ছে ছোট ও অগভীর বদ্ধ জলাশয়। যেখানে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মাছ চাষ করা যায়। প্রয়োজনে পুকুরে সহজেই সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ফেলা যায়। আদর্শ পুকুর তৈরি করা যায় খুব সহজে।

বলা হয়ে থাকে পুকুর হচ্ছে চাষযোগ্য মাছের উপযুক্ত বাসস্থান। পুকুরে পানি স্থির অবস্থায় থাকে। তবে বাতাসের প্রভাবে এতে অল্প ঢেউ সৃষ্টি হয়। পুকুরের আয়তন কয়েক শতাংশ থেকে কয়েক একর হতে পারে। তবে ছোট ও মাঝারি আকারের পুকুর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুবিধাজনক এবং এরা অধিকতর উৎপাদনশীল হয়।

আদর্শ পুকুরের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে:

* মাছ চাষের পুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যা চাষ প্রক্রিয়াকে লাভজনক করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একটি আদর্শ মাছ চাষের পুকুরের যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার তা জেনে নিন।

* পুকুরটি বন্যামুক্ত হবে। এজন্য পুকুরের পাড় যথেষ্ট উঁচু হতে হবে।
* পুকুরের মাটি দোআঁশ, পলি-দোআঁশ বা এঁটেল-দোআঁশ হলে সবচেয়ে ভালো।
* সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত।
* পুকুরের পানির গভীরতা ০.৭৫ থেকে ২ মিটার সুবিধাজনক।

* পুকুরটি খোলামেলা স্থানে হলে ভালো হয় এবং পাড়ে বড় গাছপালা থাকবে না। এতে পুকুর প্রচুর আলো-বাতাস পাবে। ফলে পুকুরে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হবে ও মাছের খাদ্য বেশি তৈরি হবে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মিশবে। উত্তর-দক্ষিণমুখী পুকুর সূর্যের আলো বেশি পাবে।
* পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকা উচিত নয়। তলার কাদার পুরুত্ব ২০ থেকে ২৫ সে.মি. এর বেশি হওয়া ঠিক নয়।

* চাষের পুকুরের আয়তন ২০ থেকে ২৫ শতক হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পুকুরের আকৃতি আয়তাকার হলে ভালো। এতে করে জাল টেনে মাছ ধরা সহজ হয়।
* পুকুরের পাড়গুলো ১:২ হারে ঢালু হলে সবচেয়ে ভালো। অর্থাৎ, পুকুরের তলা হতে পুকুরের পাড় যতটুকু উঁচু হবে পাড় ঢালু হয়ে পুকুরের তলার দিকে দ্বিগুণ দূরত্বে গিয়ে মিশবে।

মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানির যেসব গুণাগুণ থাকা দরকার:

মাছের বেঁচে থাকা, খাদ্যগ্রহণ ও আশানুরূপ বৃদ্ধির জন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় থাকা দরকার। পুকুরে পানির গুণাগুণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়,-

* ভৌত গুণাগুণ
* রাসায়নিক গুণাগুণ।

ভৌত গুণাগুণ:

* গভীরতা: পুকুর বেশি গভীর হলে সূর্যের আলো পুকুরের গভীরতার শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে অধিক গভীর অঞ্চলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাংকটন তৈরি হয় না। আবার সেখানে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। অন্যদিকে পুকুর অগভীর হলে গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। এসব কারণে মাছের ক্ষতি হতে পারে ও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

* সূর্যালোক: যে পুকুরে সূর্যালোক বেশি পড়ে সেখানে সালোকসংশ্লেষণ ভালো হয়। ফলে সেখানে ফাইটোপ্লাংটন বেশি উৎপাদিত হয় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

* তাপমাত্রা: তাপমাত্রার বৃদ্ধির উপর মাছের বৃদ্ধির নির্ভর করে। যেমন: মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এ কারণে শীতকালে পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। রুই জাতীয় মাছের বৃদ্ধি ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে ভালো হয়।

* ঘোলাত্ব: কাদা কণার কারণে পুকুরের পানি ঘোলা হলে পানিতে সূর্যালোক প্রবেশে বাঁধা পায়। এতে করে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়।

রাসায়নিক গুণাগুণ:

* দ্রবীভূত অক্সিজেন: পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত ফাইটোপ্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় যে অক্সিজেন তৈরি করে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত হয়। বায়ুমণ্ডল হতে সরাসরি পানির উপরিভাগেও কিছু অক্সিজেন মিশ্রিত হয়। পুকুরে বসবাসকারী মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণি এ অক্সিজেনি দিয়ে শ্বাসকার্য চালায়।

রাতে সূর্যের আলোর অভাবে সালোকসংশ্লেষণ হয় না বলে পানিতে কোনো অক্সিজেন তৈরি হয় না। এজন্য সকালে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় ও বিকেলে বেশি থাকে। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ মিলিলিটার (৫ পিপিএম বা ১ মিলিয়ন ভাগের পাঁচ ভাগ) থাকা প্রয়োজন।

* দ্রবীভূত কার্বনডাই অক্সাইড: পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত দ্রবীভূত কার্বনডাই অক্সাইড থাকা প্রয়োজন। তবে মাত্রাতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইড মাছের জন্য ক্ষতিকর। পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের মাত্রা ১২ মিলিলিটারের (১২ পিপিএম) নিচে থাকলে তা মাছ ও চিংড়ির জন্য বিষাক্ত নয়। মাছের ভালো উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরের পানিতে ১ থেকে ২ পিপিএম কার্বনডাই অক্সাইড থাকা প্রয়োজন।

* ফসফরাস: প্রাকৃতিক পানিতে অল্প পরিমাণ ফসফরাস থাকে। এই ফসফরাস ফসফেটে রূপান্তরিত হয়। পরিমিত ফসফেটের উপস্থিতিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোপ্লাংটন জন্মায়।

* পিএইচ: মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানির পিএইচ ৬.৫ হতে ৮.০ এর মধ্যে হলে ভালো হয়। ৬.৫ এর নিচে পিএইচ হলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। পিএইচ ৪ এর নিচে বা ১১ এর উপরে হলে মাছ মারা যায়। পানির পিএইচ কমে গেলে পুকুরে চুন (১ থেকে ২ কেজি) প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে ক্ষারীয় অবস্থা বেশি বেড়ে গেলে এমোনিয়াম সালফেট বা তেঁতুল পানিতে গুলে পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৬ জুন ২০২১