মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলে বাদামের বাম্পার ফলন

305

65000000757-1

মো. সো‌হেল রানা খান, মা‌নিকগঞ্জ থেকে: আবহাওয়া অনুকূলে থাকায়, নদীতে পানি দেরিতে আসায় মানিকগঞ্জ জেলার চরাঞ্চলে এবার বাদামের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি। বাদাম তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা।

এ বছর ঘন ঘন ঝড় ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধান ও পাটের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাদামের আবাদে কোনো প্রভাব পড়েনি। ফলে ফলনও বেশি হয়েছে।

মানিকগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বাদাম আবাদ হয়েছে। জেলার চরাঞ্চলে ২ হাজার ৩ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চাষ হয়েছে ২ হাজার ১৯৪ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন।

জেলার শিবালয়, দৌলতপুর ও হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলে বাদাম চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে শিবালয় উপজেলার শিবালয় ও তেওতা ইউনিয়নের কানাইদিয়া, চরশিবালয়, নিয়ালপুর, জিকুটিয়া, চরসাদুল্লাহ, পহুরপার, তেওতা, মালুচিসহ চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায় দিগন্ত জুড়ে সবুজ বাদাম গাছের সমারোহ।

শিবাল‌য়ের নিয়ালপুর এলাকার কৃষক মো. তৈয়ুব বলেন, “আমি ১৫/১৬ বছর ধরে বাদাম চাষ করছি। অতিরিক্ত খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে না পড়লে বাদাম চাষে লাভবান হওয়া খুব সহজ। জমি চাষ করে শুধু একবার বাদামের বীজ বপন করে আসলেই হয়। অন্যান্য ফসলের মতো এত পরিচর্যা করতে হয় না। সময়মতো শুধু জমি থেকে গাছ তুলে এনে বাদাম ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে গুদামজাত করেই কাজ শেষ।”

তিনি আরো বলেন, “বাদাম চাষে ভয় শুধু খরা ও আগাম বন্যা। গত বছর আগাম বন্যায় আমার ৩৫ বিঘা জমির বাদাম তলিয়ে যায়। এতে প্রায় দেড় লাখ টাকা ক্ষতি হয়। এবার আশা করি সে ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। চলতি বছর আমি ৩৩ বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় ৭ হাজার টাকা হিসেবে খরচ হয় ২ লাখ ৩১ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ফলন ৬ মণ হিসেবে প্রায় ২শ মণ বাদাম পাব বলে আশা করছি। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতিমণ ২ হাজার ৪শ টাকা হিসেবে ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে এবার আমার প্রায় ২ লাখ টাকা লাভ হবে। ছয় মাস পরে বিক্রি করতে পারলে আরো বেশি লাভ হতো। ধান ও পাটের চেয়ে বাদাম চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় এলাকার অনেক কৃষক বাদাম চাষে ঝুঁকে পড়েছে। বর্তমানে সেখানে প্রতি কেজি বাদাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।”

দৌলতপুর উপজেলার আমতলী এলাকার চাষি আরশেদ আলী (৪৩) জানান, গত বছর বন্যায় বাদাম চাষের জমি তলিয়ে যাওয়ায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তিনিসহ আরও প্রায় অর্ধ শতাধিক চাষি। তবে এবার সে রকম কিছু না থাকায় বেশ ভালো ফলন হয়েছে। এতে ১২ বিঘা জমি থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকার মতো মুনাফা হবে তার।

একই উপ‌জেলার বইন্যা গ্রামের চাষি মুনছের মিয়া (৫২) জানান, নদী এলাকায় ফসলের আবাদ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোন সময় নদীর ভাঙন শুরু হলে ফসলের জমি চলে যায় নদীগর্ভে। তাই অল্প খরচে বাদাম চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ আরও বেশি। তবে চলতি বছর বাদাম চাষে তারা সবাই বেশ লাভবান হ‌য়ে‌ছে।

হরিরামপুর উপজেলার উজানকান্দি এলাকার মৃত কৃষক সাহেব আলী (৫৫) বাদাম চাষ করে। পদ্মাপাড়ের জমিতে অন্যান্য ফসলের চেয়ে বাদাম চাষ বেশ লাভজনক বলেই জানান তিনি। কম পরিশ্রমে অধিক ফলন হওয়ায় লাভও বেশি। তাই প্রতিবছরই বাদাম চাষ করেন এ কৃষক।

একই এলাকার চাষি আব্দুর রহমান জানায়, প্রতি বিঘা জমিতে বাদাম চাষে সবমিলে খরচ প্রায় ৫/৬ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ৬ মণ বাদাম পাওয়া যায়। প্রতি মণ বাদামের বর্তমান বাজারদর প্রায় তেইশ থেকে আড়াই হাজার টাকা। সেই হিসেবে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ১৪/১৫ হাজার টাকার বাদাম বিক্রি করা যায়। বাদামের গাছগুলোও জ্বালানি হিসেবে বেশ চাহিদা রয়েছে। চরাঞ্চলের জমিগুলোতে অন্যান্য ফসলের চেয়ে তাই বাদাম চাষই বেশ লাভজনক।

শিবালয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানায়, বাদাম চাষ লাভজনক হওয়ায় শিবালয়ে গতবারের চেয়ে এবার বেশি বাদাম চাষ হয়েছে। চলতি বছর ১৬৩ হেক্টর জমিতে সাড়ে ৪শ মেট্রিক টন বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর ১২৭ হেক্টর জমিতে ৩২৫ মেট্রিক টন বাদাম উৎপাদন হয়েছিল। এবার আমরা শিবালয়, দৌলতপুর ও হরিরামপুর চরাঞ্চলে চিনা বাদামের আশানুরূপ ফলনের আশা করছি। কারণ বাদাম চাষের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। ঘন ঘন বৃষ্টি এবং আগাম বন্যা না হওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে।”

জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কর্মকর্তা জ্ঞানেশ চন্দ্র রায় জানান, চরাঞ্চলের বেলে-দোঁআশ মাটিগুলো বাদাম চাষের জন্য বেশ উপযোগী। যে কারণে জেলার চরাঞ্চলের এলাকাগুলোতে বাদামের চাষ হয় বেশি। চলতি বছরে জেলায় বাদাম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা তিন হাজার ২০৫ মেট্রিক টন। অনুকূল আবহাওয়ায় এবার বাদামের বাম্পার ফলন হওয়ায় বাদাম চাষিরা বেশ লাভবান।”

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম