যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে সবধরণের ফিড উৎপাদন

439

যেকোনো সময় পোল্ট্রি, ডেইরি ও ফিস ফিড উৎপাদন বন্ধ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) নেতৃবৃন্দ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গত দুই বছরে সয়াবিন মিলের দাম ৮৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্যান্য কাঁচামালের দর বেড়েছে ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ছোট ফিড মিল বন্ধ হয়ে গেছে।

এফআইএবি বলছে, বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদি পশুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এক্ষেত্রে বড় বড় ফিড মিলগুলো তাদের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে; বেশ কিছু ছোট মিল এবং অনেক ব্রয়লার খামার ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন খরচের সাথে বাজারমূল্যের সামঞ্জস্য না থাকায় চরম হতাশা বিরাজ করছে পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খামারিদের মাঝে।

গতকাল শানিবার (১৯ মার্চ) সাংবাদিকদের সাথে এক ভার্চুয়াল মতবিনিময়সভায় এ উদ্বেগের কথা জানান তারা। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনটি হলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে হুমকির মুখে পড়বে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা।

ফিডের দাম বৃদ্ধির তথ্য জানিয়ে এফআইএবি সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, বিগত কয়েক মাস যাবৎ লোকসান গুনতে থাকা ফিড মিলগুলোর পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকেছে। ফিড মিলাররা মনে করেছিলেন কাঁচামালের দর সহনীয় হয়ে আসবে; কিন্তু তা হয়নি বরং প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। বর্তমানে কাঁচামালসহ মোট উৎপাদন খরচ এতটাই বেড়েছে যে প্রতি কেজি ব্রয়লার ফিডে ৩-৪ টাকা, লেয়ার ফিডে ২.৫০-৩.৫০ টাকা, ক্যাটেল ফিডে ৩.৫০-৪ টাকা, ডুবন্ত ফিশ ফিডে ২.৫০-৩.৫০ টাকা এবং ভাসমান ফিশ ফিডে ৪-৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

এছাড়া এফআইএবির সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ফিড তৈরিতে যে পরিমাণ খরচ হয় তার প্রায় ৮০ শতাংশই হয় কাঁচামাল ক্রয় বাবদ। ২০২০ সালের মার্চে ভুট্টার দাম ছিল প্রতি কেজি ২৪.১৭ টাকা, চলতি মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৩৭ টাকা। ৩৭.২৫ টাকার সয়াবিন মিলের দাম এখন ৭০ টাকা। ৩৮.৫০ টাকার ফুল ফ্যাট সয়াবিনের দাম এখন প্রায় ৬৬.৯০ টাকা। ২১.২৫ টাকার রাইস পলিস কিনতে হচ্ছে ৩৬.৩৩ টাকায়। ১৩৩.৩৩ টাকার এল-লাইসিন ২০০ টাকা, ২০০ টাকার ডিএলএম ৩০০ টাকায়, ৫৪ টাকার পোল্ট্রি মিল ৮০ টাকায় এবং ১০০ টাকার ফিশ মিল ১৪৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

আহসানুজ্জামান বলেন, ফিড তৈরিতে ৫০-৫৫ শতাংশ ভুট্টা এবং ৩০-৩৫ শতাংশ সয়াবিন মিলের দরকার হয়। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন মিলের দর ৩০ শতাংশ এবং ভুট্টার দাম ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে ভোজ্য তেল কম্পানি ও সিড ক্রাশারদের যখন চাপ দেওয়া হচ্ছে তখন তারা তেলের দাম কিছুটা কমিয়ে সয়াবিন খৈল বা সয়াবিন মিলের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত বছরের আগস্টে সয়াবিন মিলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৪ টাকা, চলতি বছরে তা করা হয় ৬০ টাকা, গত ১৬ মার্চে ডিও মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ টাকায় অথচ ভোজ্য তেল আমদানিতে সরকার ১০ শতাংশ মূসক ছাড় দিয়েছে। দেশের বাজারে সয়াবিন মিলের দাম যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে তা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও অনেক বেশি।

আহসানুজ্জামান আরো বলেন, হাতে গোনা তনি-চারটি সিড ক্রাশিং কম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশীয় পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাত। তাই এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকেও (ক্যাব) সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। কারণ ডিম, দুধ, মাছ, মাংসের উৎপাদন খরচ বাড়লে তা সাধারণ ভোক্তাদের কাঁধে গিয়েই পড়বে।

এদিকে পোল্ট্রি খাত নিয়ে কাজ করা বৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহাম্মদ মহসিন এগ্রিকেয়ার২৪.কম বলেন, বৈশ্বিকভাবেই পোল্ট্রি খাদ্য উপাদান বা কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খামারিদের রক্ষার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন। সরকার পাটের বস্তায় খাদ্য পরিবহনের যে আইন করেছে তাতে এই সংকট আরো বৃদ্ধি করবে। পাটের বস্তায় খাদ্য ভালো থাকবে না, নষ্ট হয়ে যাবে।

মহসিন আরোও বলেন, এফআইএবি খাদ্য উপৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার মতো এতবড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। হয়ত আবারও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি হতে পারে। কারণ, ভুট্টার দাম আবার বাড়তি।

এফআইএবির সিনিয়র সহসভাপতি আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, কাঁচামালের দর বৃদ্ধিতে ফিড মিলগুলোই যে শুধু বিপাকে পড়েছে তাই নয়; ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন চেইন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

তিনি বলেন, কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে এলসি করা থেকে শুরু করে বন্দরে মাল এসে পৌঁছনো পর্যন্ত গড়ে প্রায় ৫০ দিন সময় লাগে; যুক্তরাষ্ট্র থেকে সময় লাগে প্রায় ৭০ দিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে খাদ্যশস্যের সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ক্রুড অয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়েছে, টাকা দিয়েও কিছু কিছু পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ডাটা পোর্টাল ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী ভুট্টা ও সয়াবিনের দর সর্বকালের রেকর্ড ছুঁয়েছে।

শাহরিয়ার বলেন, দেশে কাঁচামালের তীব্র সংকট এবং খামারিদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পুনরায় সয়াবিন মিল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্ত থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই সরে আসা উচিত।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের’ (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান। তার মতে, এটি একটি সংকটকালীন সময়। একদিকে যেমন দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে হবে অন্যদিকে পুষ্টিকর খাদ্য ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হবে; অন্যথায় ভয়াবহ খাদ্য ও পুষ্টি সংকটে পড়বে দেশ, প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।

সংকট উত্তোরণে ২০২৫ সাল পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধার দাবি জানিয়েছেন এফআইএবি কোষাধ্যক্ষ এবং বিপিআইসিসির সহসভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ। তিনি বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ খাতটির জন্য সরকার কর অবকাশ সুবিধা প্রদান করেছিল। এক্ষণে সে সুবিধা পুনরায় অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘কৃষির জন্য সরকার নানাবিধ প্রণোদনা ও সুবিধা দিয়ে আসছে কিন্তু কৃষির বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও এ খাতটির জন্য সরকারি কোনো প্রণোদনা নেই। আমরা নগদ অর্থ চাই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিড প্রস্তুতকারক শিল্পের জন্য ব্যাংকের সুদের হার ৪.৫ শতাংশে নির্ধারণ, পূর্বের ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ এবং আগামী এক বছরের জন্য ব্যাংক ইনস্টলমেন্ট বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রত্যাশা করছি। সেই সাথে আসন্ন জাতীয় বাজেটে পোল্ট্রি, মৎস্য ও পশুখাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত সব ধরনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সকল প্রকার আগাম কর (এটি), অগ্রিম আয়কর (এআইটি), উৎস কর (সোর্স ট্যাক্স), মূসক ও শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি। ‘

এফআইএবির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে কারসাজি করছেন কিছু ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক। কাজেই এদিকেও সরকারের নজর দেওয়া দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির অজুহাতে দেশীয় বাজারে অযৌক্তিকভাবে কাঁচামালের দর বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। ২০২৪ সাল নাগাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘের এসডিজি অর্জন করতে হলে সবার জন্য সাশ্রয়ী দামে খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করতেই হবে।

নজরুল বলেন, সংকট আরো ঘনীভূত হলে পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে; দেশীয় পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাত মুখ থুবড়ে পড়বে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২০মার্চ ২০২২