যেভাবে কেঁচো সার উৎপাদন করবেন ও তার ব্যবহার

2746

15823600_370732079954458_4538270534207140682_n
কেঁচো সার কি ?

প্রকৃতির লাঙ্গল নামে পরিচিত কেঁচো জিবন চক্রে খাদ্য খেয়ে যে মল ত্যাগ করে চা পাতার ন্যায় দেখতে ঝুর ঝুরে কেঁচোর ত্যাগকৃত এই মলই কেঁচো সার।এটি পৃথিবীতে অধিক ব্যবহৃত জৈব সারের অন্যতম,পরিবেশ বান্ধব সার।

কেঁচো সার কত প্রকার ?

এখন পর্যন্ত আমার জানা মতে বিজ্ঞানিদের ভাষায় কেঁচো সার ১ প্রকার। কেঁচোর ত্যাগকৃত মল। কিন্তু আমরা বিশেষভাবে কেঁচোর শরিরের নির্যাষ এবং সারের নির্যাষ নিয়ে তরল কেঁচো সার বর্তমানে পরিক্ষামুলক ব্যাবহার করে ভাল ফল পাচ্ছি।

কেঁচো সার কিভাবে কোথায় ব্যবহার করব ?

মাটির স্বাস্থ রক্ষায় মাটিতে কেঁচো সার ব্যবহার করলে মাটি থেকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের ৯ থেকে ১৪(কেঁচোকে সরবারহকৃত খাদ্যের প্রকারভেদ অনুসারে) টি নির্দোষ রাসয়নিক খাদ্য উপাদান উদ্ভিদ পেতে পারে।অর্থাৎ মাটিতে কেঁচোসার প্রয়োগ করলে মাটি কেঁচো সারের উপাদান ব্যাবহার করে উদ্ভিদকে ৯-১৪ টি খাদ্য উপাদান সরবারহ করতে পারে।

কি ধরনের কেঁচো দিয়ে সার উৎপাদন করব ?

হ্যা,কেঁচোসার উৎপাদন করতে আমরা আমাদের পরিবেশে প্রাপ্ত কেঁচো নয় বরং বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ব্যাবহার করব।আমার জানা সর্বশেষ তথ্য মতে বিজ্ঞানিরা ৫৫০০ প্রজাতির কেঁচো নিয়ে গবেষনা করে, কেঁচোর খাদ্য গ্রহনের ও মল ত্যাগের ক্ষমতা এবং কেঁচোর শরিরে মাটির প্রয়োজনিয় বিশেষ নির্দোষ রাসয়নিক উপাদানের বিশেষত্বেকে বিবেচনায় নিয়ে বানিজ্যিক ভাবে কেঁচোসার উৎপাদনের জন্য চারটি প্রজাতির কেঁচো নির্বাচন করেন।

বাংলাদেশে কখন কারা কেঁচো চাষ শুরু করে ?

৮০ র দশকে ইউএনডিবি রিউপা প্রকল্প এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৈথভাবে বাংলাদেশে কেঁচোচাষের সূচনা করে। কৃষক পর্যায় প্রশিক্ষণ দিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন এবং কৃষিকাজে এ সারের ব্যাবহারের প্রবর্তন করে।

কেঁচো কোথায় পাব ?

শুরুতে বাংলাদেশ বাংক অষ্ট্রলিয়া থেকে কেঁচো আমদানী করে চাষ শুরু করে।এর পরে বিভিন্ন সময় প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যাক্তি পর্যায় ভিয়েতনাম,থাইল্যান্ড,চীন,অষ্ট্রেলিয়া,ভারত থেকে কেঁচো আমদানী হয়।তবে বর্তমানে দেশে বিভিন্ন খামারে পর্যাপ্ত কেঁচো পাওয়া যায়।বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি কেজি কেঁচোর দাম ৫০০০টাকা নির্ধারন করে।তবে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত কেঁচো মজুদ থাকায় দাম কেজি প্রতি স্থান ভেদে ২০০০-২৫০০ টাকার মধ্যে।

প্রতিপালন ব্যাবস্থাঃ

কেঁচে অন্ধকার সেতস্যাতে পরিবেশে জীবন ধারনপছন্দকরে।আলো,রোদ,বৃষ্টি,ব্যাঙ্গ, পিপিলিকা, ছুচো,পাখি মুরগি,গুইশাপ ইত্যাদি কেঁচোর শত্রু।

কেঁচো চাষের জন্য উচু যায়গা নির্বাচন করে মাটির ভিটি তৈরী করে ঘর তৈরী করে নিতে হবে। ঘর করার জন্য ছন,খর,নারিকেলের পাতা দিয়ে চালা তৈরী করে নেয়া যেতে পারে। ব্যায় সাশ্রয়ে খুটির জন্য বাশ ও বেরার জন্য পাটকাঠি নারিকেলপাতা, সুপারির পাতা, ছন,খর ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

ভিটি পাকা বা পাকা হাউজ করলে পিপিলিকার আক্রমণ থেকে খামারকে রক্ষা করতে ভিটিতে চারিদিকে ৩” গভির পানির নালা করতে হবে। হাউজ পাঁকা না করলে মাটির চারি অথবা সেনিট্যারী রিং ব্যাবহার করে কেঁচো চাষ করা যায়।চারিতে করলে কেঁচো খামারের ভিটির মাটি খুরে চাড়ির উপরিভাগ থেকে ৩” বাদ রেখে মাটির মধ্যে চাড়ি বসিয়ে নিতে হবে। খামারে একাধিক চাড়ি স্থাপন করা যেতে পারে।চাড়ি /রিং পদ্ধতিতেও ইচ্ছা করলে স্বল্প ব্যায়ে মেঝেতে সলিং ছারা ২” ডালাই দিয়ে প্লাষ্টার করে নেয়া যায়।একই ভাবে ঘরের মেঝের চারিদিকে পানির নালার ব্যবস্থা করা যায়। কোনরুপ সিমেন্টের কাজ করতে না চাইলে মেঝেতে চারিদিকে ৩” নালা করে মোটা পলিথিন দিয়ে পলিথিনের জোরার মুখে সিমেন্ট / কাঁদা দিয়ে জোরার মুখ আটকে পানির ব্যাবস্থা করা যায়।এভাবে খামারের ভৌত অবকাঠামো তৈরী হয়ে গেলে গোয়াল থেকে গোবর সংগ্রহ করে খামারের এককোণে/চাড়িতে/রিং এ/হাউজে রাখতে হবে।

৪৫% গোবর+ ২৫% কলাগাছ কুচি +২৫% কচুরিপনার সবুজ অংশ (কাল মুল অংশ কেটে বাদ দিতে হবে) ২/৩খন্ড করে দিতে হবে + ৫% গিরস্থলির উচ্ছিষ্ঠাংশ/তরিতরকারীর অবশিষ্ঠাংশ/গাছের সবুজ কঁচি পাতা ইত্যাদি একত্রে মিলিয়ে সামান্য পানি দিয়ে পায়ে পারাতে হবে। অতপর খর /ছালার চট দিয়ে ১৫/২৫ দিন ঢেকে রাখতে হবে।এই ১৫/২৫ দিনের মধ্যে পারলে২/৩ বার সামান্য পানি ছিটিয়ে পায়ে পারাতে হবে। এখন মাঝারী সাইজের পূর্বে সংগ্রিহীত চাড়ি/ রিং/হাউজে কেঁচোর জন্য তৈরী করা খাদ্য ভর্তী করে দিয়ে প্রতিটি হাউজে/চাড়িতে/রিং এ ২০০০-৩০০০ কেঁচো ছারতে হবে।চাড়ি/রিং/হাউজের উপরি ভাগে মশারি নেট/সবুজ কটের নেট দিয়ে ঢেকে সুন্দর করে বেঁধে দিতে হবে।এবং ছালার চট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।কেঁচোর আবাস স্থল অন্ধকার করে দিতে হবে।মাঝে মধ্যে প্রয়োজন হলে ছালার চটের উপর থেকে সামান্য পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।মনে রাখতে হবে কেঁচো দাত বিহীন প্রানী।কেঁচো লেহন করে খাদ্য গ্রহন করে।তাই গোবর ও অন্যান্য উপাদান যেন প্রয়োজন মতো নরম থাকে।আরার অতিরিক্ত নরম না হয়। এমন নরম না হয় যে কেঁচো খেয়ে যে মল ত্যাগ করে তা পুনরায় কেঁচোর খাদ্যের সাথে মিসে না যায়।

মনে রাখতে হবে কেঁচোর ডি কম্পোষ্ট (কেঁচোর খাদ্য)তৈরীতে গোবর ১৫/২৫ দিন পচালেই গেবরে খতিকারক এ্যামনিয়া সহ অন্যান্য রাসয়নিক অপসারিত হয় কিন্তু কচিরিপনা এবং কলাগাছ কুচি পচেঁ ডি কম্পোষ্ট হতে ২/৩ মাস সময় প্রয়োজন তাই কচুরিপনা এবং কলাগাছ কুচি গেবরের পূর্বে পচিয়ে নিতে হবে।অন্যদিকে গোবর ৬০ দিনে কম্পোষ্ট হয়ে যায়, ঐ গোবরে কেঁচোর প্রয়োজনীয় খাদ্য থাকেনা।তাই মোটামুটি ১৫-৪৫ দিনের বেশি পচানো গোবর কেঁচোকে খাদ্য হিসাবে দেয়া ঠিক না।কেঁচোর খাদ্যে বেশি পরিমান তরকারীর অবশিষ্টাংশ, কঁচি পাতা দিলে কেচোসারে নাইট্রোজেনের পরিমান বেরে যায়।অন্য দিকে নিমের কঁচি পাতা,ছাল , বাসক পাতা, ছাল বৃদ্ধি করতে পারলে কেঁচোসার ছত্রাকনাশক হিসাবে কাজ দেয়।মনে রাখতে হবে কেঁচোর খাদ্যের সাথে বালি, ছাই, তিতা জাতীয় কোন উপাদান ব্যবহার না হয়।

এভাবে চাড়িতে কেঁচো অবমুক্তির পরে কেঁচো খাবে এবং মল ত্যাগ করবে। কিছুদিন পরে দেখা যাবে, চাড়ি/রিং/হাউজের উপরিভাগে সুন্দর চা পাতার মত ঝুরঝুরে সার। তখন আলতো করে নারা চারা দিতে হবে যেন কেঁচো ভয় পেয়ে চাড়ির গভিরে প্রবেশ করে। তখন আলত করে উপরিভাগ থেকে সার উত্তোলন করে ছোট ছিদ্রযুক্ত চালুনি দিয়ে সার চালনি করে কেঁচো আলাদা করে সার সংগ্রহ করতে হবে। এখানে সংগ্রহীত সার লক্ষ্য করে দেখুন, সারের সাথে ছেট ছেট কোকুন/কেঁচোর ডিম দেখতে পাবেন। এবং খুব ছোট ছোট বাচ্চা কেঁচো দেখতে পাবেন।

সার থেকে বাচ্চা,ডিম থেকে বাচ্চা সংগ্রহঃ

এ পর্যায় আপনাকে সারের মধ্যে থেকে যাওয়া বাচ্চা এবং কোকুন থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।প্রথমে আপনি সংগ্রীহিত সার একটি পাত্রে/বস্তায় রাখুন। আপনার পরবর্তী ব্যাজের কেঁচোর জন্য যে গোবর পচিয়ে রেখেছেন তা থেকে হাতে গোল বল তৈরী করুন। বল তৈরীর সময় গোবরে এমন পরিমানে পানি ব্যাবহার করুন যেন বল আপনার হাতে লেপ্টে ভেঙ্গে না যায়। এবার বলগুলি ১২”/১৮”পর পর সারের মধ্য রেখে দিন। এবার সারের মধ্যে থাকা কোকুন গুলি ফুটে বের হয়ে খাদ্যের প্রয়োজনে ঘ্রান নিয়ে গোবরের বলে প্রবেশ করবে।বল দেবার ১০/১২ দিন পরে বল তুলে দেখুন প্রচুর পরিমান কেঁচো বলে আশ্রয় নিয়েছে।এভাবে ৩০/৪০ দিনে ৩/৪ বার বল দিয়ে বাচ্চা সংগ্রহ করুন।অতপর ছায়াযুক্ত তাপে সার সুকিয়ে আদ্রতা কমিয়ে ছিদ্রমুক্ত পলি বস্তায় ভরে, চটের বস্তাবন্দি করে সংরক্ষন করুন।

বিজ্ঞানিরা বলেন, কেঁচো গড়ে ৪০ দিনে ৮ গুন বৃদ্ধি পায়।আমরা খামারীগন বলি কেঁচো বছরে ২০/৩০ গুন বৃদ্ধি পায়।তাই ছোট আকারে খামার শুরু করলেও কেঁচো চাষ অত্যান্ত পরিবেশ বান্দব এবং লাভ জনক।

ব্যাবহারের ক্ষেত্র ও পরিমাণ
সাধারন ভাবে আমন মৌসুমের চাষে ভরা জলে কেঁচো সারের কার্যকারিতা কিছুটা কম।এছারা বোর ও আউস মৌসুমে শতাংশে প্রথম বছর ৬/৭কেজি, দিত্বিয় বছর ৫ কেজি,তৃতিয় বছর ৩ কেজি। শব্জিতে অনুরুপ ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে ভাল ফল পাওয়া যায়।পান চাষ কেঁচো সার ব্যাবহারে চমৎকার ফল আসে।এছারা মাদা পদ্ধতির শব্জি ও ফল গাছের পরিমান বিস্তারিত আগামী পর্বে দেওয়া হবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৯মার্চ২০