অভাব আর অন্ধ স্বামীকে নিয়ে পুষ্প রানীর সংগ্রামী জীবন

511

পুষ্প রানী

মো. আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি থেকে: ঝালকাঠি সদরের কৃত্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি গ্রামের একজন চাষি সুমন্ত সমাদ্দার। ১৯৯৪ সালে একটি দুর্ঘটনায় অন্ধ হন তিনি। এ অবস্থায় ১৫ বছর আগে বিয়ে করেন বানারীপাড়ার মেয়ে পুষ্পকে। তাদের সংসার জীবনে তিন ছেলে-মেয়ের জনক হয়েছেন সুমন্ত। বড় মেয়ে পিংকির বয়স ১৪ বছর, ছেলে সুমনের ৬ ও ছোট মেয়ে লক্ষীর বয়স ২ বছর।

সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে তা পেরে ওঠেন না। সংসারের জন্য অর্থ উপার্জনে ক্ষেত-খামারে কাজ করে থাকেন পুষ্প, তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে যান সুমন্ত। তবে, তার মজুরি না থাকায় বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটান তিনি।

বসতঘর আর একখণ্ড জমি ছাড়া আর কিছুই নেই অন্ধ সুমন্ত সমাদ্দারের। সেই বাড়ির চারপাশে ছোট ছোট নালা/খাল বয়ে যাওয়ায় বারো মাসই তাদের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ডিঙি নৌকা।

পুরাতন নৌকাটি ভেঙে যাওয়ায় সেটি ঘাটেই বাঁধা থাকে। এরপর নতুন একটি নৌকা দিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে সংগ্রামী জীবন পার করে যাচ্ছেন কোনো রকম। স্ত্রীর শ্রম ও ভালোবাসায় তিন সন্তান নিয়ে আর্থিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে বেশ ভালো আছেন ৪০ বছর বয়সী সুমন্ত।

স্ত্রী পুষ্প রানী বলেন, ‘‘আমার সব কাজ সহজ ও গতিশীল করে দেন তিনি। সুমন্ত অনেক ভালো একজন মানুষ। যেকারণে তার সঙ্গে সংসার করছি। সে কখনোই আমার কোনো কষ্টের কারণ হয়নি। ক্ষেত-খামারে বা অন্যের বাড়িতে যখন কাজে যাই, সে সঙ্গে যায়। বসে যে কাজগুলো করা সম্ভব সেগুলো করে, এগিয়ে দেয়। ইচ্ছা আর আমার কর্মদক্ষতার কারণে নিজ জীবনের সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।”

পেয়ারা বাগান আর সবজি চাষাবাদ সব মিলিয়ে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে সফল আত্মসংগ্রামী হিসেবে পুষ্প রানী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার এ উদ্যোগী কার্যক্রমে সহায়তা করছেন তার অন্ধ স্বামী সুমন্ত সমদ্দার।

‘‘আপনারা তো দেখলেন, আমার স্বামী বাজার থেকে আমার সঙ্গে নৌকা বেয়ে নিয়ে এসেছে, আপনাদের মনে হয়েছে সে অন্ধ, আমি হাল ধরে বৈঠা বেয়েছি আর সে বৈঠা বেয়ে গতি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। যার ফলে স্বল্প সময়ে বাড়িতে চলে এসেছি। এভাবে আমার সব কাজের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে সে।”- বলেন পুষ্প রানী।

বড় মেয়ে পিংকি বলেন, ‘‘টাকার অভাবে পড়াশুনা করতে পারিনি, মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, মানুষের ছেঁড়া জামা-কাপড় গায়ে পড়ে দিন যাপন করতে হয়েছে, ভাগ্যক্রমে ঈদ উপলক্ষে মামা-নানা বাড়ি থেকে কখনও নতুন জামা পেলে পরতাম, না হলে পুরাতন জামা দিয়েই ঈদ পালন করেছি, খাট-বিছানা-টিভি-ফ্রিজ-সোফা ইত্যাদি বাসায় থাকা তো দূরের কথা, ঘরে একটা চকিও না থাকায় মাটিতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাতে হয়, মাঝে মধ্যে ঠান্ডা লেগে অসুখ হলেও টাকার অভাবে ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ কেনা সম্ভব হতো না।”

সুমন্ত সমাদ্দার বলেন, ‘‘এই বাড়ির ভিটেটুকুন ছাড়া কিছু নেই। বছরের বিভিন্ন সময়ে স্ত্রী মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ-কর্ম করে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে। সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে পেয়ারার ৩টা ১শ ফুট লম্বা কান্দি বরগা নিয়েছেন গাছসহ। যেখানে থেকে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই ২/৩শ টাকার পেয়ারা বিক্রি করছি।”

তিনি আর ও বলেন, “আমাদের ভাগ্য ভালো খড়ার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিল। উপরওয়ালা সহায় থাকায় পেয়ারার ফলন এবার ভালোই হয়েছে। এইবার মৌসুমের শুরুতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে প্রতিমণ পেয়ারা বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর পেয়ারার ফলন কম কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বেশি আবার দামও কম। অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদিত পেয়ারাগুলো আকারে কিছুটা ছোট এবং ফলও এসেছে বিলম্বে।”

সুমন্ত সমাদ্দারের কাকাতো ভাই পরিমল সমাদ্দার জানান, স্ত্রীর হাত ধরেই বছরের পর বছর এগিয়ে চলছে অন্ধ সুমন্ত। আয়-রোজগার করে পুষ্পের কারণেই বেঁচে আছে তারা। এ পরিবারের সবাই নৌকা বাইতে জানে। তাই পথ না থাকলেও চলতে ফিরতে কষ্ট হয় না।

স্বামীর অন্ধত্ব ও দারিদ্র্যতা পুষ্পকে থামাতে পারেনি। বেঁচে থাকার জন্য পুষ্পদের এগিয়ে চলা থামবে না কখনোই। আর একদিন মেঘের পাড় ভেঙে আলোরা এসে পৌঁছবেই এ বিশ্বাসে পুষ্প রানী প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে যায়। সূত্র: এনবি।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন