ক্ষেতে পোকার আক্রমণে দিশাহারা বাঙ্গিচাষি

26

বরগুনায় নদীর মাঝে জেগে ওঠা সবুজে ঘেরা একটি চর মাঝেরচর। চতুর্দিক থেকে নদীবেষ্টিত এ চরটিতে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার প্রায় সবারই আয়ের প্রধান উৎস কৃষিকাজ। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঠিক পরামর্শের অভাবে এবার লোকসানের ঝুঁকিতে রয়েছেন এই এলাকার বাঙ্গিচাষি।

সরেজমিনে বরগুনার মাঝেরচর ঘুরে দেখা যায়, শীত মৌসুমের বিভিন্ন ফসল উৎপাদন শেষে এখন মাঠজুড়ে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন তরমুজ, বাঙ্গি, মরিচ, টমেটোসহ বিভিন্ন সবজি আবাদে। তবে এর মধ্যে বাঙ্গিচাষির সংখ্যাই বেশি। নারী ও পুরুষ সমানভাবে কাজ করছেন প্রত্যেকটি বাঙ্গির ক্ষেতে। লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছর বরগুনার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ হেক্টর জমিতে বাঙ্গি চাষ করেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে কৃষি অফিস থেকে কোনো ধরনের পরামর্শ না পেয়ে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার করতে না পারায় লোকসানের শঙ্কা করছেন মাঝেরচর এলাকার বেশিরভাগ বাঙ্গিচাষি।

ইউসুফ কবিরাজ নামে এক চাষি বলেন, রোগে আক্রান্ত হয়ে গাছের পাতা লাল হয়ে মরে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের পোকা আক্রমণ করেছে। পোকা দমন করতে পারিনি। এতে গাছের ফুল ও ফল মরে যাচ্ছে। সঠিক কোনো ওষুধ পাইনি আমরা, যে যা বলে তাই ব্যবহার করি। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয় না। দুই লাখ টাকা খরচ করে এখন এক লাখ টাকাও বিক্রি করতে পারব না।

চাষিদের সঙ্গে বাঙ্গি চাষে সহযোগিতায় মাঠে কাজ করছেন জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা করে কৃষিকাজ করি। আমাদের একটাই আসা থাকেÑউৎপাদন ভালো হলে ফসল বিক্রি করে সব ধারদেনা পরিশোধ করব। কিন্তু আমাদের কৃষিতে এখন লোকসান হয়। সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা আমরা পাই না। এমনকি কোনো প্রকার সার ও কীটনাশকও আমরা পাই না।

মাঝেরচরের আরেক বাসিন্দা মো. রিয়াজ হোসেন দুই একর জমিতে এবার বাঙ্গি চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা বাঙ্গি চাষে কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সহযোগিতা পাই না। এমনকি কৃষি অফিস থেকেও কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় আমাদের কৃষকদের কৃষিকাজে অনেক সমস্যা হয়। আমরা অফিস চিনি না আর সরকারি কোনো অফিসারও আমাদের কাছে আসেন না। বাঙ্গি চাষে যে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, তা আমাদের কাছে না থাকায় গাছ পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি গাছে এখন ফল থাকার কথা থাকলে তেমন কোনো ফল নেই। আমাদের এখান থেকে প্রতি বছর চার-পাঁচ কোটি টাকার বাঙ্গি বিক্রি হলেও সঠিক কোনো ওষুধ আমরা পাই না। এ কারণে আমাদের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কীটনাশকের ডিলার থেকে যখন যা পাই তখন তা ব্যবহার করি।

মো. কালু নামে এক শ্রমিক বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ফল অনেক কম। গত বছর আমরা মাঠ থেকে ব্যাপক পরিমাণ ফল সংগ্রহের কাজ করেছি, যা এ বছর নেই। এবার গাছে ফল হলেও বড় হওয়ার আগে তা মরে যায়।

কৃষকদের উৎপাদিত এসব বাঙ্গি কিনতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাঝেরচরে ভিড় করছেন পাইকাররা। তবে সাইজ ও মান ভালো না হওয়ায় কম দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।

কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাঙ্গিচাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে জানিয়ে বরগুনা সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম বলেন, বরগুনাতে গত বছরের তুলনায় এ বছর বাঙ্গির আবাদ কিছুটা কম। কৃষি অধিদপ্তর এ ফসলকে উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে বিবেচনা করে। এ কারণে কৃষকদের আমরা সব সময়ই বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করি। এছাড়া এ ফসলের আবাদ ও যত্ন নেয়া অন্য সব ফসলের থেকে একটু কঠিন। আমাদের কারিগরি দিকসহ প্রকল্পের আওতায় যে কোনো সহযোগিতা, যেমন সার ওষুধসহ যা থাকে তা আমরা সবসময়ই কৃষকদের দিয়ে থাকি।

বরগুনার মাঝেরচর নামক এ চরটিতে ২০০৫ সাল থেকে মানুষের বসবাস শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ও ঘরবাড়ি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন এখানকার বাসিন্দারা। পরে জেলা প্রশাসনের সহোযোগিতায় আবারও ঘরবাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন মাঝের চরের বাসিন্দারা।