গুজবে না দিয়ে কান, নিয়মিত ডিম খান

1207

022957eggs_kalerkantho_pic

ডিম হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির স্ত্রী জাতির পারা একটি গোলাকার বা ডিম্বাকার জিনিস যা মেমব্রেনের স্তর দ্বারা ঘিরে থাকা ডিম্বক এবং বহিরাবরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়। বহিরাবরণের মূল কাজ হলো এর অভ্যন্তরে বাড়তে থাকা ভ্রূণকে এবং ভ্রূণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকে রক্ষা করা। মুরগির ডিমসহ বেশিরভাগ মুখরোচক ডিমই শক্ত বহিরাবরণ বা ডিমের খোসা, অ্যালবুমেন (সাদা অংশ), ডিমের কুসুম এবং কিছু মেমব্রেন দিয়ে তৈরি। ডিমের সকল অংশই খাদ্যপোযোগী, যদিও খোসা সাধারণত বাদ দেয়া হয়। পুষ্টিগতভাবে ডিম প্রোটিন ও কোলিনের উৎকৃষ্ট উৎস। ডিম অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি খাবার। এছাড়া এটি খুব সস্তা ও সহজলভ্য।

প্রতি ১০০ গ্রাম সেদ্ধ ডিমে পওয়া যায় ১৫৫ কিলো ক্যালরি শক্তি, ১২.৬ গ্রাম প্রোটিন, ১.১২৬ গ্রাম শর্করা, ১০.৬ গ্রাম স্নেহ পদার্থ এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলস। সেই জন্য ডিমকে বলা হয় পাওয়ার হাউস অব নিউট্রিশন অর্থাৎ পুষ্টির শক্তির ঘর।

প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে ডিম হলো আদর্শ প্রোটিন। এখানে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এটি শরীরের অনেক উপকারে আসে। ডিম শুধু আদর্শ প্রোটিনই নয় বরং অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এতে রয়েছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। এটি হৃদরোগের বিরুদ্ধে অনেক কার্যকরী।

একটি বড় ডিম থেকে অনেক নিউট্রিয়েন্টস (পুষ্টি উপাদান) পাওয়া যায়। যেমন: ভিটামিন বি৬, বি১২, রিবোফ্লাভিন, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ প্রভৃতি। একটা বয়েলড বা সিদ্ধ ডিম স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। একটি ডিমের মধ্যে ৭০ থেকে ৭২ কিলোক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। ডিমের প্রোটিন পুরোটাই শরীরের কাজে লাগে। এটি মাংসপেশির গঠনে সাহায্য করে। ডিম থেকে অনেক কম কার্বোহাইড্রেট আসে। তাই একটি সিদ্ধ ডিম কুসুমসহ প্রোটিনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করলে সেটি ওজন কমাতে অনেক সাহায্য করে।

একটি মুরগির ডিমের বিভিন্ন অংশ: ১. ডিমের খোসা ২. বহিঃমেমব্রেন ৩. অন্তঃমেমব্রেন ৪. চালাজা (Chalaza) ৫. বহিঃঅ্যালবুমেন ৬. মধ্য-অ্যালবুমেন ৭. ভিটেলাইন মেমব্রেন ৮. নিউক্লিয়াস অব প্যান্ডার ৯. গার্মিনাল চাকতি ১০. হলুদ কুসুম ১১. সাদা কুসুম ১২. অন্তঃঅ্যালবুমেন ১৩. চালাজা ১৪. বায়ু কোষ ১৫. কিউটিকল।

ডিমের এত গুণের মাঝে ইদানিং শোনা যাচ্ছে প্লাস্টিক বা নকল ডিমের কথা। বিভিন্ন মিডিয়া হতে জানা যায়, ২০০৪ সাল থেকেই চীনে নকল ডিম তৈরি হচ্ছে, সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমারে। নকল ডিমে কোনো খাদ্যগুণ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্টো এতে থাকা ক্যালসিয়াম কার্বনেট, স্টার্চ, রেসিন, জিলেটিন মানুষের শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বেশিদিন ধরে এই ডিম খেলে ক্যান্সারসহ কিডনিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আসল ডিম এবং নকল ডিম/প্লাস্টিক চেনার উপায়। নকল ডিম চেনার যেসব উপায় বলা হচ্ছে, সে গুলো হলো:
-কৃত্রিম ডিম অনেক বেশি ভঙ্গুর। এর খোসা অল্প চাপেই ভেঙে যায়।
-এই ডিম সিদ্ধ করলে কুসুম বর্ণহীন হয়ে যায়।
-ভাঙার পর আসল ডিমের মতো কুসুম এক জায়গায় না থেকে খানিকটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় পুরো কুসুমটাই নষ্ট ডিমের মত ছড়ানো থাকে।
-কৃত্রিম ডিম আকারে আসল ডিমের তুলনায় সামান্য বড়|
-এর খোলস খুব মসৃণ হয়। খোসায় প্রায়ই বিন্দু বিন্দু ফুটকি দাগ দেখা যায়।
-রান্না করার পর এই ডিমে অনেক সময়ই বাজে গন্ধ হয়। কিংবা গন্ধ ছাড়া থাকে। আসল কুসুমের গন্ধ পাওয়া যায় না।
-নকল ডিমকে যদি আপনি সাবান বা অন্য কোন তীব্র গন্ধ যুক্ত বস্তুর সাথে রাখেন, ডিমের মাঝে সেই গন্ধ ঢুকে যায়। রান্নার পরেও ডিম থেকে সাবানের গন্ধই পেতে থাকবেন।
-নকল ডিমের আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য লক্ষণ হলো ডিম দিয়ে তৈরি খাবারে এটা ডিমের কাজ করে না। যেমন পুডিং বা কাবাবে ডিম দিলেন বাইনডার হিসাবে। কিন্তু রান্নার পর দেখবেন কাবাব ফেটে যাবে, পুডিং জমবে না।
-নকল ডিমের আকৃতি অন্য ডিমের তুলনায় তুলনামূলক লম্বাটে ধরণের হয়ে থাকে।
-নকল ডিমের কুসুমের চারপাশে রাসায়নিকের পর্দা থাকে বিধায় অক্ষত কুসুম পাওয়া গেলে সেই কুসুম কাঁচা কিংবা রান্না অবস্থাতে সহজে ভাঙতে চায় না।
-আসল ডিম ভাঙলে মুড়মুড়ে শব্দ হয়। কিন্তু প্লাস্টিকের ডিমে তেমন শব্দ হয় না।
-আসল ডিম ভেঙে রেখে দিলে পিঁপড়া বা পোকামাকড় আসে। কিন্তু নকল ডিমে পোকামাকড় আসে না।
– সাধারণ ডিমের চেয়ে এই ডিম বেশি ঝকঝকে।

এখান আসা যাক পচা ডিম চেনার উপায়। পচা ডিম ভাঙার পর সাদা অংশ ও কুসুম এক হয়ে যায়, ডিম ঝাঁকালে পানি গড়ানোর মতো শব্দ হয়। ডিম ভাঙলে পচা গন্ধ পাওয়া যায়। ডিম কিনে জলের বাটিতে ফেলবেন এবং যদি দেখেন ডুবে বাটির নিচে আছে তাহলে তাজা ডিম। যদি মাঝামাঝি ডুবে থাকে তাহলে ভাল ডিম কিন্ত কয়দিন পুরানো। আর যদি ভেসে থাকে তাহলে বুঝবেন খারাপ/পচা ডিম। বাংলাদেশে সম্ভবত: প্লাস্টিকের ডিমের গল্প একটি গুজব। ওগুলো হতে পারে পচা ডিম।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আতাউল গনি রাব্বনী কাছ থেকে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা হতে ডিমের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি কোনো নকল বা প্লাস্টিক ডিমের সন্ধান পাননি। তিনি মন্তব্য করেছেন, দেশের ডিমের বাজারে কোনো নকল ডিম নেই, এটি নিতান্তই গুজব। যারা নকল ডিমের বৈশিষ্টের কথা বলছেন, আসলে তারা না জেনে পচা ডিমের বৈশিষ্টগুলো উল্লেখ করছেন। দেশের অগ্রসরায়মান পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের কারিগর হিসেবে কাজ করছেন।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্লাস্টিকের ডিম নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আমাদের দেশেও এই আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যেকেই ডিম কেনার সময় পরীক্ষা করে নিচ্ছে আসল না নকল। অনেকেই আবার ডিম খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্লাস্টিকের ডিম বলে কোনো বস্তু বাজারে নেই।

প্লাস্টিক ডিম হিসেবে যে সব ডিমের কথা উল্লেখ্য করা হচ্ছে সেগুলো থেকে পারে ফার্মের যেসব ডিম নিষিক্ত করার জন্য সরিয়ে রাখা হয় তেমনই কিছু ডিম বাজারে এসে গেছে। সাধারণত হিসেবে যেসব ডিমের কথা উল্লেখ্য করা হচ্ছে সেগুলো হতে পারে ফার্মের যেসব ডিম এই ধরনের ডিম কিনে নিয়ে যান এবং দোকানীরা সেগুলো বিক্রি করে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গের কড়োয়ের বাসিন্দা অনিতা কুমারও সেরকমই ডিম পেয়েছিলেন। আরো একটা কারণ রয়েছে। ডিমে থাকে অ্যালবুমিন প্রোটিন । প্রচণ্ড গরমে এই প্রোটিনের রূপ পরিবর্তন হতে পারে। ফলে হলদে অংশ জেলির মতো হতে পারে। এই ধরনের ডিম পোড়ালে দুর্গন্ধ ছড়ানো অস্বাভাবিক নয়।

বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, কেন প্লাস্টিকের ডিম বেচা সম্ভব নয়? একটা ডিমের খরচ পড়ে ৪ রুপি। এই টাকায় কী প্লাস্টিক দিয়ে ডিম বানানো সম্ভব! তাও আবার উন্নতমানের প্লাস্টিক দিয়ে! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অসম্ভব।

চীনে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত ডিম যদি দেশের বাজারে ঢুকে পড়ে তাহলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে, কারণ এত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। ইউটিউব বা অন্যান্য মিডিয়াতে কৃত্রিম ডিম তৈরির যে সব ভিডিও দেখা যায়, সেখানে শুধুমাত্র কুসুম তৈরি পর্যন্ত পাওয়া, পরিপূর্ণ ডিম তৈরির ভিডিও দেখা যায় না।

প্রশ্ন এসে যায় আসলেই কি কৃত্রিম বা প্লাস্টিক ডিমের অস্তিত্ব আছে? চীনে উৎপাদন করে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করলে লাভজনক হবে? বাংলাদেশের বাজারে সবচেয়ে সস্তা প্রোটিন হচ্ছে ডিম। বাংলাদেশের এই শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য তৈরি হচ্ছে নীল নকশা। ডিম ছাড়া এখন কারো জীবন চলে না। সবাই নিজেরা ডিম খাই এবং ছোট-বড় সন্তানদের ভালবেসে এই ডিম খাওয়াই। আমরা মনে করি এই বিষয়ে সরকারের সকল মহলের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দেশের সকল নাগরিককেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

এ কাজ কারা করছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া হোক। তারা প্রিয় এই ডিম শিল্পকে ধ্বংস করতে চায়, ক্ষতি করতে চায় এ দেশের মানুষের।
দেশের স্বার্থে এবং নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদে প্রতিদিন একটি করে ডিম খান। হ্যাঁ একটু দেখে নিন। গুজবে কান দেবেন না।

আরো পড়ৃন:

লেখক: ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (প্রাণিসম্পদ)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
ফার্মগেট, ঢাকা।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম