চুন কি মাছের রোগ নিরাময় করে?

1017

মাছ-2

পুকুর বা জলাশয়ের মাছে রোগ হলে অথবা রোগজনিত কারণে মাছ মারা যেতে থাকলে চাষিরা পুকুর বা জলাশয়ে চুন দিয়ে থাকেন। আমরাও অনেক সময় চুন দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।

চুন দিলে কি মাছের রোগ নিরাময় হয়? রোগ নিরাময় হলে কিভাবে হয় তা জানার চেষ্টা করি। চুনে ক্যালশিয়াম(Ca), অক্সিজেন ( O), হাইড্রোজেন (H), কার্বন (C), ম্যাগনেশিয়াম (Mg) ইত্যাদি মৌল থাকে। চুনের এ মৌলগুলির আলাদাভাবে জীবাণুনাশ করার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া পানিতে চুন প্রয়োগ করলে এমন কোন মৌল বা যৌগের সৃষ্টি হয় না যা দ্বারা মাছের রোগের জীবাণু ধ্বংস হয়। চুন অক্সিডাইজিং এজেন্টও নয়। অর্থাৎ চুন ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারে না। চুন অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারলে ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে জায়মান অক্সিজেন (O) তৈরি করতে পারত।। এই জায়মান অক্সিজেন রোগের জীবাণুনাশ করে থাকে । চুনের এ ক্ষমতা নেই সুতরাং চুন মাছের রোগ জীবাণুনাশকারী উপাদান বা যৌগ নয়।

আমরা বলে থাকি চুন প্রয়োগ করলে পচনশীল জৈব পদার্থের পচনক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এ পচনক্রিয়া ঘটায় ব্যাক্টেরিয়া। অর্থাৎ চুন প্রয়োগ করলে পুকুরে পচনক্রিয়ায় সহায়তাকারী ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।

অপরদিকে আমরা আরও বলে থাকি চুন দিলে রোগসৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়াসহ অন্যান্য জীবাণু ধ্বংস হয় বা মারা যায়। আর এজন্য পুকুর বা জলাশয়ের মাছে রোগ দেখা দেয়ামাত্রই চুন প্রয়োগ করে থাকি বা চুন দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমরা ভেবে দেখেছি কি? কিভাবে? কখন,? কি পরিমাণ ? চুন প্রয়োগ করলে জৈব পদার্থের পচন ত্বরান্বিতকারী বা উপকারী ব্যাক্টেরিয়া বৃদ্ধি পাবে এবং রোগসৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণু মারা যাবে। এছাড়া শুধুমাত্র উপকারী ব্যাক্টেরিয়া বাঁচিয়ে রেখে বেছে বেছে ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণু মেরে ফেলার এমন অলৌকিক ক্ষমতাও চুনের নেই। এরপরও – “ চুনের এমনই গুণ, যেমন সব তরকারিতেই নুন”এমন সস্তা স্লোগান দিয়ে মাছ চাষের পুকুর বা জলাশয়ে চুন প্রয়োগে উৎসাহিত করা হয়।

প্রিয় পাঠক চুনের রয়েছে অম্লকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা ( neutralizing power)। অর্থাৎ পানিতে চুন প্রয়োগ করলে পানির pH বেড়ে যায়।

চুন প্রয়োগের পর পানির pH অনুকূল মাত্রায় অর্থাৎ ৬.৫ – ৮.৫ এর মাঝে থাকলে জৈব বর্জ্য পদার্থ পচনে সহায়তাকারী ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ ও সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে মাছ চাষের পুকুর বা জলাশয়ে জৈব বর্জ্য পরিমাণ কমে যায় এবং অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
পানির pH ৯.০ এর ওপরে থাকলে ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ভাইরাস ধবংস হয়। অর্থাৎ চুন দিয়ে পানির pH ৯.০ এর ওপরে উঠিয়ে নিলেই কেবল জীবাণুনাশকরুপি ব্যাক্টিরিয়া ও ভাইরাস মারা যাবে বা ধবংস হবে।
চুন প্রয়োগের ফলে পানির pH ১১.০ এর ওপরে গেলে পুকুর বা জলাশয়ের মাছও মারা যাবে।
সুতরাং মাছের রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসকে ধবংস করতে হলে পুকুরে চুন প্রয়োগ করে পানির pH ৯.০ এর ওপরে নিতে হবে। কিন্তু pH বাড়িয়ে রোগের জীবাণুনাশ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়াও মারা যাবে।

তাছাড়া চুন প্রয়োগ করে রোগের জীবাণু নাশ করার উদ্দেশ্যে মাছচাষের পুকুর বা জলাশয়ের পানির pH ৯.০ এর ওপরে নিলে পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

অ্যামোনিয়ার পরিমাণ দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে ০.০৫ মি.লি. গ্রাম/লি. বা তার বেশি থাকলে মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, FCR বেশি হয়, মাছ অসস্থিকর ( stress condition) অবস্থায় থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, মাছে ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ সংক্রমনের প্রবনতা বেড়ে যায় এবং মাছচাষ অলাভজনক হয়। অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ২.০ মি.লি.গ্রাম/লি. থাকলে মাছের ফুলকা পচে যায়, কিডনি ও স্প্লিন নষ্ট হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় দেখা যাচ্ছে মাছচাষের পুকুর বা জলাশয়ে চুন প্রয়োগ করে পানির pH ৯.০ এর ওপরে নিয়ে রোগ নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ করা আত্মঘাতী। তাছাড়া মাছচাষরত অবস্থায় পানিতে পূর্ণ এরুপ পুকুর বা জলাশয়ে প্রচলিত মাত্রায় চুন প্রয়োগ করলে কোন অবস্থাতেই পানির pH ৯.০ এর উপরে উঠে না বা উঠবে না। সুতরাং প্রচলিত মাত্রায় চুন প্রয়োগ করলে পুকুর বা জলাশয়ের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু মারা যাবে না বা ধবংস হবে না।

মাছের ব্যাক্টেরিয়াজনিত কারনে রোগ হলে এবং সে সময় পানির pH ৬.৫ – ৮.৫ থাকলে এ অবস্থায় চুন প্রয়োগ করে রোগ নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার অর্থ চুনের বা অর্থের অপচয় করা। মাছচাষে অর্থের অপচয় রোধ করে মাছচাষকে লাভজনক করা এই মুহূর্তে একটি চ্যালেঞ্জ বিষয়। মাছচাষকে sustainable করতে হলে মাছচাষ লাভজনক করতে হবে। তার জন্য অবশ্যই উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।

সারকথা:
মাছ চাষকালীন সময়ে দেখা যায় পুকুর বা জলাশয়ে জৈব বর্জ্যের অধিক ঘনত্বের কারনে অথবা ফাইটোপ্লাংক্টনের অধিক ঘনত্বের কারনে কার্প জাতীয় মাছের ফুলকা বন্ধ (gill block) হয়ে মারা গিয়ে থাকে। এরুপ সময় প্রতি শতাংসে ২৫০ – ৫০০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করলে উপকার পাওয়া যায়।

পুকুর বা জলাশয়ের পানি শুকিয়ে তলায় ছিপ ছিপে পানি থাকলে বা ভিজে নরম কাদায় প্রতি শতাংশে ১.০ – ২.০ কেজি( প্রয়োজনে আরো বেশি) চুন প্রয়োগ করতে হবে। এ অবস্থায় পুকুর বা জলাশয়ের তলার ছিপছিপে পানি বা নরম কাদার pH ১১.০ এর ওপরে উঠবে। ফলে ব্যাক্টেরিয়াসহ রোগ সৃষ্টিকারী সকল পরজীবী মারা যাবে। চুন প্রয়োগে pH ১১.০ বেশি হলে মাছসহ সকল জলজ জীব মারা যাবে। পুকুরে শামুক,ঝিনুক থাকলে, তাও মারা যাবে।

এছাড়া পানির pH অনুকূল মাত্রায় রাখার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী চুন ব্যবহার করতে হবে। pH অনুকূল মাত্রায় থাকলে অযথা পুকুরে চুন প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই।

পুকুর বা জলাশয়ে পরজীবী বা ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত মাছের রোগ নিরাময়ের জন্য সঠিক চিকিৎসা না করে অযথা চুন প্রয়োগ করবো না বা চুন প্রয়োগের পরামর্শ দিব না।

মাছচাষের পুকুর বা জলাশয়ে অনুমান নির্ভর নয় বরং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাচেতনা দিয়ে আমরা সকলে চুন প্রয়োগ করবো এবং চাষিভাইদেরকেও সেরুপ পরামর্শ দিব।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪ফেব্রু২০২০