জনপ্রিয় মসলা ফসল চুইঝাল

1916

3a7464a836f918453cdfa4a542152e9c5qg9o66u2ji6xoi4lp8w
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় জেলাসমূহে চুইঝাল একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ মসলা ফসল। বিশেষ করে বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইল প্রভৃতি জেলায় চুইঝালের চাষ করা হয়। চুইঝালের চাষ প্রধানত বসতবাড়িতেই সীমাবদ্ধ। চুইঝালকে সবাই চেনে ‘চই’ বা ‘চুই’ নামে। সাধারণ মানের এক কেজি চুইয়ের দাম দুইশ থেকে তিনশ টাকা। আর পুরনো মোটা বয়েসী পাকা চুই হলে তো কথাই নেই, আটশ টাকা কেজিও বিক্রি হয়। এ হিসাবে এক একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চুই চাষ করে বছরে প্রায় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। এ অঞ্চলের পুরনো লোকদের মুখে এখনো চুইয়ের স্বাদ লেগে আছে।

চুইয়ের ব্যবহার

মসলা হিসেবে চুইগাছের শেকড় ও কান্ড ব্যবহার করা হয়। ভেষজ ওষুধ তৈরির জন্য ফল, বীজ ও লতা ব্যবহার করা হয়। শেকড় ও কান্ডের কালচে বাকল চেঁছে তুলে ফেলে লম্বা ফালি ফালি করে রান্নার সময় তরকারি বা মাছের ঝোলে, মাংসের কারিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। এতে রান্নায় সুঘ্রাণ আসে, ঝাল হয় ও স্বাদ বেড়ে যায়। তা ছাড়া চুইগাছের ঝাল মরিচের চেয়ে উপকারী, স্বাস্থ্যসম্মত ও ভেষজ গুণসম্পন্ন।

চাষের উপযুক্ত স্থান

ছায়া বা আধো ছায়া জায়গাতে চুই ভালো হয়। সাধারণত বসতবাড়ির আঙিনায় এ ধরনের স্থানে চুইঝালের গাছ লাগানো হয়। চুইঝালের গাছ জলাবদ্ধতা সইতে পারে না। তাই নিচু বা পানি আসে বা জমে থাকে এরূপ জায়গায় চুইঝালের গাছ না লাগানো ভালো। বড় কোনো গাছ যেমন জিওল বা জিকা, মেহগনি, আম ইত্যাদি গাছের পাশে চুইঝাল লাগানো উচিত। ১০টি গাছ লাগাতে প্রায় ১ শতক জায়গা লাগে। জমির পরিমাণ নির্ভর করে বাউনি তুলে দেয়া গাছের সংখ্যা ও দূরত্বের ওপরে।

জমি ও গর্ত তৈরি

গাছ লাগানোর জায়গা ঠিক করার পর সেখানে সবদিকে এক হাত মাপে গর্ত তৈরি করতে হবে। সে গর্তের মাটির সঙ্গে ১৫-২০ কেজি গোবর সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ১০০ গ্রাম জিপসাম ও ২৫ গ্রাম জিংক সালফেট সার মিশিয়ে দিয়ে গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। গর্ত ভরাটের পর তা যেন ঢিবির মতো উঁচু হয়।

চারা তৈরি

বীজ, ডাল ও শিকড় থেকে চুইগাছের নতুন চারা হয়। ফল পাকলে তার উপরের নরম আবরণ ফেলে দিয়ে রোদে শুকিয়ে বীজ রেখে দিলে তা অনেকদিন ভালো থাকে। বীজতলায় বীজ ভিজিয়ে ফেললে সেসব বীজ থেকে চারা গজায়। বয়স্ক কান্ড ও শেকড়ের গিঁট কেটে মাটিতে পুঁতে দিলে সেখান থেকেও চারা বের হয়। কৃষকরা নিজেদের গাছ থেকে সাধারণত: কাটিং করে চারা তৈরি করে। যদি অন্যের কাছ থেকে কিনতে হয় সে ক্ষেত্রে প্রতিটি চারার দাম ১৫-২৫ টাকা হতে পারে।

চারা রোপণ

বর্ষার আগে বা বর্ষায় গর্ত করে চুই লতার বা শেকড়ের কাটিং সরাসরি মাটিতে পুঁতে দিলে সেখান থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কাটিংয়ে অন্তত তিনটি গিঁট থাকে যার এক থেকে দুটি গিঁট মাটির নিচে পুঁততে হবে। এ ছাড়া পলিব্যাগেও বীজ থেকে বা লতার কাটিং থেকে চারা তৈরি করে সেসব চারা গর্তে লাগানো যায়। গর্তে জৈব সার দিলে বাড়বাড়তি ভালো হয়। চারা মাটিতে লেগে যাওয়ার পর ৮ থেকে ১০ মাস বয়সের ডাল বা লতা খাওয়ার উপযুক্ত হয়। সাধারণত বসতবাড়ির আঙিনাতেই এ দেশে চুই চাষ করা হয়।

বাউনি দেয়া ও মাটি তোলা

আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, দেবদারু, নিম, মেহগনি, শিরিষ প্রভৃতি গাছে চুই লতিয়ে বাড়তে পারে। চুঁইগাছ একবার কোনো গাছকে আঁকড়ে ধরলে তাকে ঝড়ও আর সরাতে পারে না। এ জন্য কোনো ফলের গাছে চুঁইঝালের গাছ তুলে দেয়া উচিত না। এতে সে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়। আম ও জিকা/কচা গাছে তুলে দিলে ভালো ফলন দেয়। বাউনি ছাড়াও চুই হয়। সে ক্ষেত্রে মাটিতেই চুই গাছের ঝোপ হয়। তাকে বলে আইটে চুই। বর্ষার আগে প্রতিটি গাছের গোড়ায় মাটি তুলে উঁচু করে দিতে হয়।

সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা

চারা লাগানোর সপ্তাহখানেক আগে গোবর ও অন্যান্য সার গর্তের মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি গাছের গোড়ায় বছরে একবার বর্ষা শেষে ২৫-৫০ গ্রাম ইউরিয়া দিতে হবে। সার দেয়ার সময় গাছের গোড়ায় মাটি হালকা করে কুপিয়ে সেচ দিতে হবে। চুইগাছে সাধারণত কোনো সেচ দেয়া লাগে না। তবে চৈত্র্য-বৈশাখ মাসে গাছের গোড়ায় নিয়মিতভাবে সেচ দিলে ভালো হয়।

চুইঝাল কাটা

চারা লাগানোর ৩ বছর পর আহরণযোগ্য হয়। ৫ থেকে ৭ বছরের গাছে ভালো মানসম্পন্ন চুইঝাল পাওয়া যায়। কান্ড বা লতা কাটার পর অবশিষ্টাংশ থেকে আবার নতুন লতা কাটার পর সেখান থেকে আবার নতুন করে ডাল বা লতা বের হয়। সেসব লতা আবার পরে চুইঝালে পরিণত হয়। তবে ৫ থেকে ৭ বছর পর সম্পূর্ণ গাছ তুলে আবার নতুন গাছ লাগানো ভালো।

ফলন মজুত ও বিক্রি

বয়সভেদে চুইঝালের ফলনও ভিন্ন হয়। ৩-৪ বছর বয়েসী একটি গাছে ১.৫-২.০ কেজি চুইঝাল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ৮-১০ বছরের একটি গাছ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত চুই পাওয়া যায়। চুইঝালের গাছ কাটার পর দ্রম্নত শুকাতে থাকে। শুকালে তার বাজারমূল্য কমে যায়। এ জন্য কাটা কান্ড বা ডালপালা সবসময় পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। আঁটি বেঁধে তাতে পানির ছিটা দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে ভালো হয়। ভেজা কাপড় বা চট দিয়ে পেঁচিয়েও রাখা যায়। কাটারি দিয়ে ডাল টুকরো করে কেটে ওজনে চুইঝাল বিক্রি করা হয়। মোটা ও গিঁটযুক্ত খন্ড অনেক সময় লম্বালম্বিভাবে কেটে দুভাগে ফালি করেও বিক্রি করা হয়।