পাটের কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় দিশাহারা কৃষক

101

মৌসুমে পাটের চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষকরা। গত দুই মৌসুমে পাটের ভালো দাম পেলেও, এবার কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা। পাট বিক্রি করে খরচের টাকায় উঠে আসছে না। চাষিদের দাবি গত বছরের তুলনায় এ বছর একই সময়ে প্রতি মণে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা কম দামে পাট কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। চাষিদের উৎপাদন খরচ বিবেচনায় পাট বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমিয়ে রেখেছেন এমনটা দাবি করছেন কৃষকরা।

কৃষকরা বলছেন- পাট চাষে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে। মজুরির ব্যয়, সার, কীটনাশক ও বীজসহ চাষাবাদের খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি বিঘা পাটের উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় পাট উৎপাদন হচ্ছে ৫ থেকে ৬ মণ। এক মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকায়। এতে প্রতি বিঘা পাট চাষে লোকসান হচ্ছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। বাজারে পাটের দাম পড়তির দিকে। গত বছর এ সময় পাট ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মণ ছিল। এক বছরের ব্যবধানে পাটের দাম প্রতি মণে প্রায় এক হাজার টাকা কমেছে। এতে লোকসানে পড়েছেন চাষিরা। গতকাল রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দুর্গাপুরহাটে পাট বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ১৯শ থেকে ২২৫০ টাকা দরে। একই মানের পাট গত বছর বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার থেকে ৩২শ টাকা দরে। সেই হিসেবে পাটচাষিরা এ বছর পাট বিক্রি করে প্রতি মণে ১ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন।

উপজেলার দুর্গাপুরহাটে পাট বিক্রি করতে আসেন আশরাফুল হক। তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় পাটের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। আমার মতো সব পাটচাষির লোকসান হচ্ছে। পাটের দাম বৃদ্ধি না করলে যে ফসলে লোকসান হচ্ছে, সেই ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দেবে কৃষক। পাট চাষ করে আমাদের পোষাচ্ছে না। এবার পাটের চাহিদাও কম। ব্যবসায়ীরা পাটের প্রতি তেমন আগ্রহী না। পাটচাষিদের প্রতি সরকার নজর দিক, দাম বৃদ্ধি করে দিক। তাছাড়া লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে আগামীতে অনেকেই পাট চাষ করা বন্ধ করে দেবে।

পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকার কৃষক বেলাল হোসেন ১ বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, পাট চাষে যে পরিশ্রম করি সেই টাকা পাই না। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের দাম মণে ১ হাজার টাকা কম। পানির সংকটের কারণে এ বছর পাট জাগ সংকুচিত হওয়ায় কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা ভেদে এক বিঘা জমির পাট কেটে পানিতে জাগ দিতে একেক কৃষকের খরচ হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। শুধু তা-ই নয়, পাট শুকানো, পাট বাঁধাই করা, গাড়িতে করে হাটে নিয়ে আসা পর্যন্ত কৃষকের খরচ হয়। অনেক ব্যবসায়ী গত বছরের পাট বিক্রি করতে পারেনি। এ জন্য এ বছর ঝুঁকি নিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। পাটচাষি ও ব্যবসায়ীরা উভয়েই বিপাকে পড়েছে। বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম এলাকার বর্গাচাষি মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, অন্যের এক বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। এবার কামলার সঙ্গে আমি নিজেও হাড়ভাঙা খাটুনি দিছি। কিন্তু যে অবস্থা দেখতেছি, তাতে লাভ তো দূরের কথা, ঘরের টাকা ঘরে নেয়া কঠিন হয়ে যাবে। তুলনামূলক পাট বিক্রি করে কৃষকের মণে ১ হাজার টাকা লোকসান হবে এ বছর। কারণ লাভের টাকা পাট জাগ দেয়া বাবাদ শেষ হয়েছে। এ বছর কোনো কৃষক নিজের ইচ্ছামতো সহজ জায়গায় পাটের জাগ দিতে পারেনি। কারণ পানির অভাব। অনেকেই আবার পাট জাগ দিতে পুকুরও ভাড়া নিয়েছে। কৃষককে এক মণ পাট তৈরি করতে প্রায় ২ হাজার টাকা খরচই পড়েছে। কিন্তু হাটে এসে কৃষককে সেই পাট বিক্রি করতে হচ্ছে ২ হাজার টাকা মণ দরে। পাট চাষ করে যদি আমাদের ক্ষতি হয় সে আবাদ আর করব না।

রাজশাহী জেলার বিভিন্ন হাট থেকে পাট কেনেন মাহাবুবুল আলম। তার পুঠিয়ার উপজেলায় বানেশ্বর হাটে পাটের আড়ত রয়েছে। পাটের ব্যবসার সঙ্গে তিনি ১২ বছরের বেশি সময় ধরে জড়িত। ব্যবসায়ী হলেও তার কথায় উঠে এসেছে কৃষক পাটের দাম কম পাচ্ছে। মাহাবুবুল আলম বলেন, পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কৃষক। বর্তমানে ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি হচ্ছে। গত বছর মৌসুমের শুরুতে ৩ হাজার টাকা মণ দরে পাট কিনেছেন তিনি। তিনি বলেন, পাট চাষ থেকে শুরু করে হাট পর্যন্ত শুধু খরচ। তাতে করে ২ হাজার ৭শ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ হলে কৃষকের লোকসান হবে না।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রাজশাহী জেলায় ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ৪৪২ হেক্টর বেশি জমিতে এ পাটের চাষ হয়েছে। চাষিদের মধ্যে অনেকের জমিতে এখনও পাট রয়েছে। অনেকেই পাট কেটে জাগ দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার বিক্রিও করছেন হাট-বাজারে। তবে বেশির ভাগ উপজেলায় বর্তমানে পাট কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছড়ানো এবং শুকানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, গত বছরের তুলনায় প্রতি মণে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা পাটের দাম কম। তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, যেসব দেশ বাংলাদেশের কাঁচা পাট কেনে, তারা বিশ্বমন্দার কারণে পাট কিনছে না। ফলে আমাদের দেশের পাট রপ্তানি করতে পারছি না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যাচাই-বাছাই করে পাট কিনছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, যেকোনো ফসল ওঠার সময় সিন্ডিকেটের দখলে পড়ে যায়। সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে রাখা হয়। বিষয়টি সরকারকে দেখা দরকার। কোনোভাবেই কৃষকদের হতাশ করা যাবে না। সরকারকে প্রতি বছর পাটের একটা ন্যায্য দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে।