মেহেরপুরকে মডেল খামারবাড়িতে রূপান্তর করলেন আখতারুজ্জামান

389

কৃষি প্রধান বাংলাদেশের একটা সমৃদ্ধ জানালা হলো মেহেরপুরের কৃষি। ভৌগলিকভাবে পকেট জেলা। কৃষি প্রধান আয়তনে ছোট্ট এ জেলা শীত গ্রীষ্ম বর্ষাা সব মৌসুমে সবুজের সমারোহে ভরে থাকে। গোটা মেহেরপুরের সকল মাঠই যেন একেকটি প্রদর্শনী খামার। কৃষি উন্নয়নের সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পদে মেহেরপুরে বিগত ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে কর্মরত কৃষিবিদ ড. আখতারুজ্জামান। তিনিই মেহেরপুর জেলাকে মডেল খামারবাড়িতে রূপান্তর করেছেন।

মেহেরপুরের কৃষকদের কৃষি সমস্যার সমাধানের জন্যে তিনি তাঁর নিজ উদ্যোগে চালু করেছেন “মেহেরপুর অনলাইন কৃষিসেবা কেন্দ্র”। অনলাইন কৃষিসেবা কেন্দ্রে অফিস চলাকালীন সময়ে ফোন করে মেহেরপুর কৃষির যেকোন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান নিতে পারছেন মেহেরপুরের আগ্রহী আমজনতা।

সরকারি কৃষি পরিসেবা ও আবহাওয়ার আগাম খবরাখবর প্রগতিশীল কৃষকদের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বাল্ক ক্ষুদেবার্তার (Meherpur Ag) মাধ্যমে। এসবই ড. জামানের উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড। মডেল খামারবাড়ির অদূরে সেকেলের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম্য আদলের ছনবেষ্টিত বৈঠকখানায় বসে কথা হচ্ছিল ড. আখতারুজ্জামানের সাথে। কথা বলার এক ফাঁকে তিনি তাঁর মডেল খামারবাড়ির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে বলেন- “অনলাইনে বিজ্ঞপ্তি দেখে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ব্যাংককে অনুষ্ঠিতব্য6th International Conference on Agriculture, 2019 এ উপস্থাপনের জন্যে মডেল খামারবাড়ির উপরে ”Model farmhouse” শিারোনামে ২৫০ শব্দের একটা সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছিলাম।

তিন স্তর বিশিষ্ট কমিটির বিশ্লেষণের পরে আমন্ত্রণপত্র পাঠান। এটার প্রেক্ষিতে আগামী ২০ আগস্ট থাই লায়ন এয়ারে করে ঢাকা ত্যাগ করবার কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২২ আগস্ট বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২. ৪০ মিনিটে আমার খামারবাড়ি মডেল আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে উপস্থাপিত হবে।

ড. আখতারুজ্জামানের সবচে বড় উদ্ভাবনী কাজ হচ্ছে তাঁর অফিস চত্বরের সন্মুখস্থ পরিত্যক্ত জায়গাতে “মডেল খামারবাড়ি” স্থাপন। বছরখানেক আগেও যে জায়গাটিকে পথচারিরা খামারবাড়ির পরিবর্তে ব্যঙ্গ করে জঙ্গলবাড়ি বলে কটূক্তি করতেন। সন্ধ্যা হলে ভুতের বাড়ি খ্যাত খামারবাড়িতে মানুষ যেতে ভয় পেত। সেখানে এখন স্থাপিত হয়েছে নান্দনিক খামারবাড়ি মডেল।

ড. জামান জানান- কৃষকের বাড়িকে “আমার বাড়ি, আমার খামার” গড়তে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে কৃষি প্রযুক্তি যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে তেমনি কৃষক তাঁর নিজস্ব খামারবাড়ি থেকে পাচ্ছেন সব ধরনের জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত ফল ফলাদি, ডিম, দুধ, হাঁস, মাছ ইত্যাদি। সর্বোপরি কৃষকের প্রতিটি বাড়ি একেকটি খামারবাড়িতে রূপান্তরিত হলে সবুজে বাঁচবে কৃষক, সবুজকে বাঁচাবে কৃষক; সর্বোপরি সুশোভিত হবে সবুজ শ্যামলিমায় ঢাকা চিরায়ত বাংলার মুখচ্ছবি।

ড. আখতারুজ্জামান বলেন ‘পুবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ, উত্তরে নলা দক্ষিণে কলা’ মেহেরপুরের প্রবাদ পুরুষ খনার এমন বচনকে বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে খামারবাড়ি মডেল। মডেল খামারবাড়িতে প্রবেশ করতে হবে বাড়ির দক্ষিণ ফটক দিয়ে। ফটকের দুধার সুশোভিত করা হয়েছে দেবদারু বৃক্ষ দিয়ে। প্রবেশ পথ ধরে কিছুটা এগুলো সামনে পড়বে কৃষকের “খামারবাড়ি”র মূল পাকা ভবন।

ছোট্ট এ পাকা ভবনটির ছাদে শোভা পাচ্ছে ছাদ বাগান, আর বারান্দায় লাগানো হয়েছে মাটিবিহীণ হাইড্রোপনিক সবজি । বাড়ির সামনের ফাঁকা উঠানটি বেশ পরিপাটি। উঠানের সোজাসুজি সামনের দিকে চিত্ত বিনোদের জন্যে রোপণ করা হয়েছে মৌসুমি ফুল ও সুদৃশ্য গাছ। এসব ফুল গাছে আধুনিক ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে সেচ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফুলবাগানে বসানো হয়েছে, চমকপ্রদ ও অত্যাধুনিক মৌবাক্স, সেখানে তৈরি হচ্ছে নির্ভেজাল মধু।

বাড়ির প্রবেশ পথের বামে লাগানো হয়েছে গবেষণালব্ধ ১৩টি বিভিন্ন ধরনের ফলদ গাছ (আম, কাঁঠাল, লিচু, নারকেল, তাল, আমড়া, ছফেদা, কামরাঙ্গা, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু ও বাতাবী লেবু), যার মাধ্যমে বাড়ির মালিক বছরের ৩৬৫ দিনই কোন না কোন ফল পাবেন। এখানেই একটা ফলদ বৃক্ষের সাথে অসংখ্য লেমিনেশন করা স্টিকারে লেখা আছে বৃক্ষের প্রযোজনীয়তার কথকতা। বাড়ির পূর্বপাশে মিনি পুকুরের দক্ষিণে কালিকাপুর মডেল অনুসরণ করে পাঁচটি বেডে লাগানো হয়েছে পাঁচ রকমের সবজি। এ মডেল অনুসরণ করলে খামারি বছরের প্রতিদিনই তার এক শতক জমির এমন বাগান থেকে পাবেন এক কেজি করে কোন না কোন ধরনের সবজি যা তার পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পুরোপুরি মেটাবে। পুকুরে ছাড়া হয়েছে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ। মিনি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে মা ও ছানা তেলাপিয়া মাছ ও সোনা ব্যাঙের জলকেলি দেখলে আপনার মন জুড়িয়ে যাবে। মিনি পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে “ইচ্ছে পুকুর” কারণ পুকুরের চারপাশ ইচ্ছেমত সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ফলদ বৃক্ষ ও সবজি দিয়ে। খামারবাড়ির পেছনে রয়েছে লতানো সবজির মাচা। তার পাশে রয়েছে বাণিজ্যিক উলুখড়ের খেত। মেহেরপুরই দেশের একমাত্র জেলা যেখানে উলুখড় অত্যন্ত লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য হিসেবে চাষাবাদ হচ্ছে। এরপাশেই রোপণ করা হয়েছে পুষ্টিকর গোখাদ্য পাকচং ও লাল নেপিয়ার ঘাসের চারা। দ্রুত বর্ধনশীল এ ঘাস তরতরে করে বেড়ে উঠছে। এখানেই দেখা মেলবে কবুতর ঘরে বসবাসরত কপোত কপোতির বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মাতামাতির প্রেমলীলা, মুরগীর ঘরে মোরগ মুরগী, পাশের ঘরে কোয়েল পাখি ইত্যাদি।

বাড়ির পশ্চিম দিকে বিনা পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা বাঁশ বাগানের পাশেই রয়েছে ভেষজ বাগান, আমন ধান খেত, স্থায়ী ফুল বাগান ও দুষ্প্রাপ্য ফলদ বাগান। এসব বাগানে রয়েছে শত শত জীবন্ত সব ফলদ বনজ ও ভেষজ বৃক্ষের সমাহার। ধান খেতে আধুনিক ধান চাষের সকল প্রযুক্তি সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে; এসব প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে লাইন, লগো, পারচিং, এডাব্লুডি, আলোক ফাঁদ, ধানের আইলে সবজি চাষ ইত্যাদি। মডেল খামারবাড়ির পেছেন মূল খামারবাড়ির সীমানা প্রাচীরের বাইরে পরিত্যক্ত ফলের ক্রেট ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে উলম্ব পদ্ধতিতে দেয়ালে সবজি চাষ (Verticulture Wall Agriculture, সে আরেক অভিনব কৃষি প্রযুক্তি। ছাদ কৃষির পাশাপাশি এখানে চালু করা হয়েছে দেয়াল কৃষি।

এই মডেল খামারবাড়ির বিশেষত্ব হলো এখানে রোপিত প্রতিটি গাছ গাছালি ও সবজির বাংলা নাম, ইংরেজি নাম, বৈজ্ঞানিক নাম ও সেটার কিছু বৈশিষ্ট্য ছাপার হরফে দৃশ্যমান করে লেখা হয়েছে প্রতিটি ফল ও সবজি গাছের পাশে রক্ষিত বিশেষ মেটালিক নামফলকে। মেহেরপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষেরা তাঁদের স্ব স্ব বাড়িকে একেকটি আদর্শ মডেল খামারবাড়ি তৈরির জন্যে ইতোমধ্যে উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরু করেছেন; তাদের সর্বোতভাবে কারিগরী সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন মাঠ পর্যায়ে কর্মরতসম্প্রসারণ কর্মকর্তারা।- বাসস