রাজশাহীতে বোরো আবাদে ভাঙল দশকের রেকর্ড

31

রাজশাহী জেলায় কৃষি উন্নতির নতুন দিগন্ত রচনার প্রত্যাশায় কৃষকরা এবারের বোরো মৌসুমে পূর্বের সব রেকর্ড ভাঙার প্রস্তুতিতে মগ্ন। রবিশস্য উত্তোলনের আগে থেকেই বোরো আবাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। যার মধ্যে অনেকেই বীজতলায় চারা প্রস্তুত এবং জমি তৈরি করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ বোরো ধান রোপণেও এগিয়ে চলেছেন। এই সর্বজনীন প্রস্তুতির মাঝেই রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবারের বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা বোরো আবাদে ভাঙল গত এক দশকের রেকর্ড।

অনুকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়িয়ে চললে, কৃষি বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এবার বোরো আবাদ এবং উৎপাদন পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে।

কৃষি দপ্তরের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে রাজশাহীর কৃষি উন্নতি এবং অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কৃষকরা উন্নত প্রযুক্তি, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সময়োপযোগী কৃষিসামগ্রী প্রাপ্তির মাধ্যমে ফলন বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছেন। সবার প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম যদি সফল হয়, তবে এবারের বোরো মৌসুম রাজশাহীর কৃষি ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে লেখা হবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ ও চাষিরা।

এক দশকে রাজশাহীর বোরো ধান উৎপাদনে ধারাবাহিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৫,৮৩৪ হেক্টর জমিতে মোট ২ লাখ ৭১ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৭৩২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৮ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে, ৬৬ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে ধানের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন। এরপরের বছর, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭০ হাজার ১০৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৬৩ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৮৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৭৭৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ২ লাখ ৯৪ হাজার ০১৫ মেট্রিক টন ধান। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ০৮৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ০৪৫ হেক্টর জমিতে মোট ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছিল। এই সময়কালে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪.০৬ মেট্রিক টন থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে ৪.৮৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ৭০ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হবে, যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৭০ মেট্রিক টন চাল। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি, যেখানে উৎপাদন হয়েছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৩৯ মেট্রিক টন চাল। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ১ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন এবং উৎপাদনে বেড়েছে ১৩ হাজার ৬৩১ মেট্রিক টন।

চাষিরা জানিয়েছেন, বোরো আবাদে ব্যয় অধিক হয়। ভালো উৎপাদন এবং ধানের উচিত মূল্য না পাওয়া গেলে চাষিরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। বিশেষ করে, বোরো চাষে সেচের খরচ অনেক বেশি। বৃষ্টি হলে সেচের খরচ কিছুটা কমে। এ বছর বোরো বীজতলা তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। অগ্রিম বীজতলা যারা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকের ধানের চারার মান খারাপ হয়েছে। এছাড়া, এ বছর সার ও কীটনাশকের দাম অধিক। তবুও, ভালো উৎপাদনের আশায় চাষিরা আশাবাদী।

পবা উপজেলার দামকুড়ার এক বোরো চাষি আনসার আলী জানান, তিনি এ বছর দুই বিঘা জমিতে বোরো চাষ করছেন। তার জমি উঁচু হওয়ায় সেচের খরচ বেশি পড়ছে। দুই বিঘা জমির জন্য চারা তৈরি, লাগানো, জমি প্রস্তুতি এবং সার-কীটনাশকের খরচ মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আগামী দিনে আরও খরচ বাড়ার আশঙ্কা আছে।

পবা এবং গোদাগাড়ী উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে মাঠে এখন বোরো আবাদ নিয়ে চাষিরা ব্যস্ত। কেউ বীজতলা তৈরি করছেন, কেউ বীজতলা থেকে চারা সংগ্রহ করে জমিতে লাগাচ্ছেন এবং কেউ সরিষা কাটার পর বোরো ধানের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন।

গোদাগাড়ী উপজেলার আরেক বোরোচাষি ইব্রাহিম আলী বলেন, এ বছর রোদ ও কুয়াশার কারণে ধানের চারা কিছুটা খারাপ হয়েছে। তবে জমিতে চারা লাগানোর পর ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। আবহাওয়া সুন্দর থাকলে ভালো ফলনের আশা করা যায়।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, এ বছর পবা উপজেলায় ১০ হাজার ৮৫০ হেক্টর এবং গোদাগাড়ী উপজেলায় ১১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯৫ শতাংশ জমিতে বোরো আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। বোরো চাষে সার ও কীটনাশকের সরবরাহ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আলু ও সরিষা আবাদ তুলে বোরো লাগানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৬ শতাংশ বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি রোপণ হয়ে যাবে। পুরো মাঠ সবুজ হয়ে আসবে।