জেনে নিন আদার কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা

844

অনেকেই টবে আদা চাষ করেছেন । জেনে নিন আদার রোগবালাই ও তার প্রতিকার সমন্ধে।

রোগবালাই আদা উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। আদার রাইজোম রট, পাতা ঝলসানো, পাতায় দাগ, ব্যাক্টিরিয়াজনিত কন্দ পচা ও ঢলে পড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। তবে রাইজোম রট আদার বেশি ক্ষতি করে। এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। তাই আদার কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. রোগের নাম : কন্দ পচা
রোগের কারণ : পিথিয়াম এফানিডারমেটাম নামক ছত্রাক এবং ব্যাক্টিরিয়া ও রাইজোম ফ্লাইও আদা পচার সাথে জড়িত।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত রাইজোম, মাটি, পানি ও ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটে।
রোগের লক্ষণ
১. গাছের গোড়ায় কন্দতে প্রথমে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়।
২. পরে ওই স্থানে পরম পচন দেখা যায়।
৩. ক্রমান্বয়ে কন্দের বেশি বেশি অংশ পচে যায়।
৪. আক্রান্ত গাছের শিকড়ও পচতে শুরু করে এবং গাছ টান দিলে সহজেই উঠে আসে।
৫. আক্রান্ত কন্দ থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়। এ গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে রাইজোম ফ্লাই নামক পোকা আদায় আক্রমণ করে।
৬. গাছের ওপরের অংশে পাতা হলুদ হয়ে যায়। পাতায় কোনো দাগ থাকে না।
৭. পরে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়।
৮. রাইজোম পচে যাওয়ার ফলে ফলন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
রোগের প্রতিকার
১. আক্রান্ত গাছ মাটিসহ উঠিয়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
২. আক্রান্ত গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৩. রোগবিহীন কন্দ সংগ্রহ করে বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
৪. আক্রান্ত জমিতে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৫. মাঠে যথাযথ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৬. স্টেবল বিচিং পাউডার প্রতি হেক্টরে ২০ কেজি হারে শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৭. রিডোমিল গোল্ড বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ওই দ্রবণের মধ্যে বীজ আদা আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করে উঠিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে জমিতে রোপণ করতে হবে।
৮. অর্ধকাঁচা মুরগির বিষ্ঠা (৩-৫ টন/হে.) আদা বপনের ২১ দিন আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৯. রোগ দেখা দেয়া মাত্রই রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে (০.২%) অথবা সিক্যুয়র প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
২. রোগের নাম : আদা হলুদ হওয়া
রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম অক্সিমপরাসম এফএসপি. জিনজিবেরি এবং ফিউজারিয়াম সোলানি নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত রাইজোম, মাটি, পানি ও ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটে।
রোগের লক্ষণ
১. আদার নিচের পাতার কিনারায় হলুদাভ হয়ে সম্পূর্ণ পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
২. আক্রান্ত গাছ উইল্ট হয়ে শুকিয়ে যায় কিন্তু গাছ হেলে পড়ে না।
৩. আদার কন্দে ভাস্কুলার সিস্টেমে ক্রিমি ডিসক্লারেশন দেখা যায় এবং কন্দ পচতে থাকে।
রোগের প্রতিকার
১. আক্রান্ত গাছ রাইজোমসহ সম্পূর্ণরূপে তুলে ধ্বংস করতে হবে
২. বীজ আদার জন্য শুধু সুস্থ ও নিরোগ গাছ নির্বাচন।
৩. আক্রান্ত জমিতে আদা চাষ না করে অন্য ফসলের চাষ করা।
৪. জমি স্যাঁতসেঁতে ভাব রাখা যাবে না।
৫. প্রোভেক্স বা ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ওই দ্রবণের মধ্যে বীজ আদা আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করে উঠিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে জমিতে রোপণ করতে হবে।
৬. আদা লাগানোর ঠিক আগে মুহূর্তে জমিতে স্টেবল ব্লিচিং পাউডার হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
৭. রোগ দেখা দেয়া মাত্রই ব্যভিস্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৩. রোগের নাম : পাতা ঝলসানো
রোগের কারণ : কোলেটোট্রিকাম জিঞ্জিবারিস নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : আক্রান্ত পাতা, বায়ু ইত্যদি।
রোগের লক্ষণ
১. প্রথমে পাতার ওপর ছোট, গোল, হালকা হলুদ বর্ণের দাগ পড়ে।
২. পরবর্তীতে অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয়ে পাতার সব অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা ঝলসে যায়।
৩. ঝলসানো পাতার ওপর বিন্দু বিন্দু কালো দাগ দেখা যায় যেগুলো ছত্রাকের অ্যাসারভুলাস।
৪. ডগা আক্রান্ত হয়ে পাতার মাঝখানটা ভেঙে ঝুলে পড়তে দেখা যায়।
৫. ফলে গাছের ও রাইজোমের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা শুকিয়ে মারা যায়।
রোগের প্রতিকার
১. জমির ময়লা আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে।
২. রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করতে হবে।
৩. রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
৪. শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
৫. আদার কন্দ সংরক্ষণের আগে প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১ গ্রাম ব্যভিস্টিন মিশিয়ে ৬০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং ৪৮ ঘণ্টা পর সংরক্ষণ করতে হবে। আদার কন্দ লাগানের আগে ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
৬. রোগের আক্রমণ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার উভয় পৃষ্ঠায় স্প্রে করতে হবে।
উপরোক্ত রোগ ছাড়াও আদায়
৪. ব্যাক্টিরিয়াজনিত কন্দ পচা-আরউইনিয়া ক্যারোটোভোরা (Erwinia carotovora) দ্বারা,
৫. পাতায় দাগ-ফাইলোস্টিক্টা জিঞ্জিবারি (Phyllosticta zingiberi) দ্বারা এবং
৬. ঢলে পড়া-রালস্টোনিয়া সোলানেসিয়ারাম (Ralstonia solanacearum) দ্বারা হয়ে থাকে।

তথ্য: ড. কে এম খালেকুজ্জামান*
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, শিবগঞ্জ, বগুড়া।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮জুলাই২০