ধানের লোনা ধরা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

760

রোগের নাম : টুংরো (Tungro)। অনেক এলাকায় এ রোগকে লোনা ধরা, বসে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
রোগের কারণ : রাইস টুংরো ভাইরাস (Rice Tungro Virus) নামক এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : এ রোগটি আউশ ও আমন মৌসুমে বেশি হয়। টুংরো আক্রান্ত চারা রোপণের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়। সবুজ পাতাফড়িং (নেফোটেটিকস ভাইরেসেন্স), আশপাশে স্বেচ্ছায় গজানো রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান বা ঘাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। বাহক পোকা আক্রান্ত গাছ থেকে ২-৩ মিনিট কাল রস শোষণ করেই ভাইরাস সংগ্রহ করতে পারে এবং তা পরবর্তী ২-৩ মিনিটে সুস্থ গাছে রস শোষণ কালে সংক্রমণ করতে পারে। ফলে সুস্থ গাছটিতেও ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

রোগের লক্ষণ

টুংরো আক্রান্ত গাছের পাতায় প্রাথমিক অবস্থায় লম্বালম্বিভাবে শিরা বরাবর হালকা সবুজ ও হালকা হলদে রেখা দেখা দেয়। পরে আস্তে আস্তে সব পাতাটাই হলদে বা কমলা হলদে রঙ ধারণ করে। আক্রান্ত কচি পাতা হালকা রঙের হয় এবং মুচড়ে যায়। চারা/কুশি অবস্থায় আক্রান্ত হলে সুস্থ গাছের তুলনায় আক্রান্ত গাছ বেশি খাটো হয় কিন্তু বয়স্ক গাছে হলে ততোটা খাটো হয় না। আক্রান্ত গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কুশি কম হয় এবং শিকড় দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাতাগুলো ভূমির দিকে নুয়ে পড়ে। রোগাক্রান্ত গাছ ধান পাকা পর্যন্ত বাঁচতে পারে তবে আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছগুলো শুকিয়ে মরার মত হয়ে যায়। হালকাভাবে আক্রান্ত গাছ বেঁচে থাকে, তবে তাতে কিছুটা দেরিতে ফুল আসে এবং ফলন অনেক কম হয়।

রোগের প্রতিকার : রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে। হাত জাল দিয়ে সবুজ পাতাফড়িং ধরে মেরে ফেলতে হবে। টুংরো আক্রান্ত জমির আশপাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান এবং আড়ালি ঘাস দমন করতে হবে। আলোকফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলতে হবে। জমিতে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে পার্চিং করতে হবে। বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপিড (অ্যাডমায়ার/ইমিটাফ) ০.৫ মিলি/লিটার অথবা ডায়াজিনন (৬০ তরল) ১.৫ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। টোপাম্যাক ৭০ ডব্লিউ জি। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ২ গ্রাম, একর প্রতি মাত্রা ৪০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি মাত্রা ১০০ গ্রাম।

৯. রোগের নাম : উফরা রোগ (ডাক পোড়া) (Ufra)। বিভিন্ন এলাকায় এ রোগ উর্বা, ডাকপোড়া, জ্বলে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, লোনা লাগা ইত্যাদি নামে পরিচিত। সাধারণত শতকরা ৪০-১০০ ভাগ ফলন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগের কারণ : ডাইটিলেংকাস এ্যাংগাসটাস (Ditylenchus angustus) নামক এক ধরনের কৃমি দ্বারা এ রোগ হয়।

রোগের বিস্তার : সেচের পানি, ঘন ঘন বৃষ্টিপাত, মাটি, রোগাক্রান্ত চারা, নাড়া ও খড় দ্বারা এ রোগ ছড়িয়ে থাকে। শুরুতে এ রোগ জলি আমন ধানে হলেও বর্তমানে সব মৌসুমেই দেখা যায়। সেচের পানিতে ভেসে এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে আক্রমণ করে। আক্রান্ত জমির পরিত্যক্ত নাড়া, খড়কুটা, শীষের অংশ বা ঝরে যাওয়া ধানে এবং মাটিতে কোন খাদ্য ছাড়াই এ কৃমি কু-লী পাকিয়ে ৬-৮ মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

রোগের লক্ষণ : কৃমি ধান গাছের কচি পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। কৃমি গাছের রস শোষণ করায় প্রথমে পাতার গোড়ায় ছিটা-ফোটা সাদা দাগ দেখা দেয়। সাদা দাগ ক্রমে বাদামি রঙের হয় এবং পরে এ দাগ বেড়ে সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে ফেলে। অনেক সময় থোড় হতে ছড়া বের হতে পারে না বা বের হলেও অর্ধেক বা আংশিক বের হয়। ছড়া বের হতে না পারলে তা ভেতরে মোচড়ানো অবস্থায় থাকে। গাছ কিছুটা বেটে হয়। ধান খুব চিটা ও অপুষ্ট হয়। আক্রমণ থোড় গজানোর সময় হতে শুরু হলে সে ধানের কোনো ফলনই পাওয়া যায় না।

রোগের প্রতিকার : রোগাক্রান্ত ফসল কাটার পর নাড়া ও খড় জমিতেই পুড়িয়ে ফেলতে হবে; ঘাস জাতীয় আগাছা এবং মুড়ি ধান ধ্বংস করতে হবে; বছরের প্রথম বৃষ্টির পর জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন শুকাতে হবে; পর পর ধান না করে পর্যায়ক্রমে অন্য ফসলের চাষ করতে হবে; আক্রান্ত জমিতে বা জমির পাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে; প্রথম অবস্থায় আক্রমণ দেখা দিলে ধানের আগার অংশ কেটে পুড়ে ফেলতে হবে; চারা লাগানোর ১২-২০ ঘণ্টা আগে বীজতলা থেকে চারা তুলে শিকড় ১.৫% কৃমিনাশক যেমন- ফুরাডান ৫জি অথবা কুরাটার ৫ জি দ্রবণে ভিজিয়ে রেখে জমিতে রোপণ করতে হবে; জমিতে রোগ দেখা দিলে ২ ইঞ্চি পানি থাকা অবস্থায় কার্বোফুরান (সিবাফুরান, ফুরাডান ৫জি অথবা কুরাটার ৫ জি) বিঘাপ্রতি ২.৫-৩.০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১