মুরগির রক্ত আমাশয়: কার্যকরী প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা

2360

 

ককসিডিওসিস

রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস পোল্ট্রি ফার্মে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি রোগ যা মোরগ-মুরগিতে রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি, খাদ্যের রূপান্তর হার হ্রাস করে এবং দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে । আমাদের দেশে এ রোগটি এলাকাভেদে মিঠা পায়খানা , ইটা পায়খানা , তালগুড় পায়খানা , কক্রির ইত্যাদি নামে পরিচিত ।

কারণ:

রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস একটি প্রোটোজোয়াজনিত রোগ । মোরগ-মুরগি সাধারণত নিম্নলিখিত ৯ প্রকারের আইমেরিয়া প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। যেমন-আইমেরিয়া টেনেলা , আইমেরিয়া ব্রুনেটি, আইমেরিয়া ম্যাক্রিমা , আইমেরিয়া নেকাট্রিক্র, আইমেরিয়া এসারভুলিনা , আইমেরিয়া মেভেটি , আইমেরিয়া মিটিস , আইমেরিয়া হেগেনি, আইমেরিয়া প্রিকক ।

এই নয় প্রজাতির আইমেরিয়ার মধ্যে আইমেরিয়া টেনেলা, আইমেরিয়া ব্রুনেটি ও আইমেরিয়া ম্যাক্রিমা এই তিন প্রকারের প্রজাতির আইমেরিয়ার প্রকোপই সবচেয়ে বেশি এবং মারাত্মক ।

এছাড়া আইমেরিয়া নেকাট্রিক্র, আইমেরিয়া এসারভুলিনা ও অন্যান্য প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হতে ও দেখে যায় , যার ফলে প্রচুর পরিমাণে ডায়রিয়া হয়।

এপিডিমিওলজি :

গৃহপালিত প্রায় সব প্রজাতির পাখিই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে । সাধারণত অল্প ও বাড়ন্ত বয়সের মুরগি (৪-৬ সপ্তাহ ) এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে । ধারণা করা হয়, বয়স্ক মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হয় না । কিন্তু মুক্তভাবে পালিত বয়স্ক মুরগি ছোটদের মতো সমভাবে সংবেদনশীল হয়ে থাকে । সাধারণত ২-১৬ সপ্তাহ বয়সে এ রোগে আক্রন্তের হার বেশি, তবে বেশি বয়সে ও দেখা যায় । দেখা গেছে , সাধারণত ১-২ সপ্তাহ বয়সের বাচ্চাতে এ রোগ হয় না । রক্ত আমাশয়ের আক্রমণের তীব্রতা নির্ভর করে খামারে বিদ্যমান কক্রিডিয়ার ডিমের সংখ্যার ওপর এবং কি পরিমাণ ডিম মোরগ মুরগি খায় তার ওপর। স্পোরুলেটেড ওসিস্ট ভক্ষণ করলে মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে । তবে একসাথে এ ধরনের কতগুলো ওসিস্ট ভক্ষণ করেছে তার ওপর রোগের তীব্রতা পরিলক্ষিত হয় । সারা বছরই এ রোগটি দেখা যায় , তবে বর্ষাকালে এর প্রার্দুভাব বেশি হয় ।

রক্ত আমাশয়ের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি:

খামারীর অর্থনৈতিক ক্ষতির বিবেচনায় মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম । সারাবিশ্বে প্রতিবছর এ রোগের কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ছয়শ কোটি টাকা । এর মধ্যে ৭০% ক্ষতি হয় সাব ক্লিনিক্যাল ককসিডিওসিসের কারণে । যদিও আমাদের দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতির মানদণ্ডে এখন ও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি কিন্তু পার্শ্ববতী দেশ ভারতে করা গবেষণায় দেখা যায়-

বাণিজ্যিক ব্রয়লারে ৯৫.৬১% অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ ককসিডিওসিস ।
সব ধরনের পোল্ট্রির ক্ষেএে দৈহিক ওজন ৬৮.০৮% কমে যায় এবং এফসিআর ২২.৭০% বেড়ে যায় ।
সারাবিশ্বে ককসিডিওসিসের কারণে ৬-১০% ব্রয়লার মুরগির মৃত্যু ঘটে ।

বাংলাদেশের খামারে পালিত ৫৪.১৮% ও মুক্তভাবে পালিত ৪৯.৪৫% মুরগির পায়খানায় ককসিডিওসিস রোগের জীবাণু সনাক্ত করা হয়েছে । (তথ্য: পোল্ট্রি পালন ও চিকিৎসা, ডা. এম এ সামাদ)

রোগের বিস্তার পদ্ধতি:

স্পোরোলেটেড (sporulated) ওসিস্ট খেয়ে মোরগ-মুরগি ককসিডিওসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে । এখানেই এর জীবন চক্রের শুরু ,যা শেষ হয় আনস্পোরোলেটেড (unsporulated) ওসিস্ট তৈরি হয়ে তা পায়খানার সাথে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে । এর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন ঘটে থাকে । মুরগি ওসিস্ট খেয়ে আক্রান্ত হলেও ওসিস্ট কিন্তু রোগ সৃষ্টিকারী মূল জীবাণু নয় । রোগ সৃষ্টি করে স্পোরোজোয়েট যা স্পোরোসিস্ট নামক এক প্রকার থলের ভেতরে থাকে এবং এ দুটোই বাইরে থেকে শক্ত দুটি দেয়াল দিয়ে আবৃত থাকে। বাইরের প্রতিকুল পরিবেশ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই এ ব্যবস্থা ।

একটি আইমেরিয়া ওসিস্টের ভেতরে চারটি স্পোরোসিস্ট থাকে , যার প্রতিটির মধ্যে আবার দুটো করে স্পোরোজোয়েট থাকে । অর্থাৎ একটি ওসিস্ট খেয়ে একটি মুরগি আটটি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু পেয়ে থাকে । ওসিস্ট যখন মুরগি থেকে পাতলা পায়খানার সাথে বেরিয়ে আসে তখন কিন্তু এর ভেতর স্পোরোসিস্ট বা স্পোরোজোয়েট কোনটাই থাকে না ।

সাধারণত দুই থেকে আট সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চা ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয় । তবে এ সময় কালের মধ্যে রক্ত আমাশয় না হলে বাকি জীবনের পরবর্তী যে কোন সময় ককসিডিয়ার সয়ংর্স্পশে এলে এবং তা খেয়ে ফেললে রক্ত আমাশয় রোগ সৃষ্টি হতে পারে । কোন একটি প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রক্ত আমাশয় হলে মোরগ-মুরগি সেই প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করে কিন্তু অন্য প্রজাতির প্রতি সংবেদনশীল থাকে । ফলে অন্য প্রজাতির আইমেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মোরগ মুরগির রক্ত আমাশয় হতে পারে ।

প্রতিটি প্রজাতির আইমেরিয়া মোরগ-মুরগির পরিপাকতন্তের নির্দিষ্ট স্থানে আক্রমণ করে । কখনই তাদের নিদিষ্ট লক্ষ্যস্থল ছেড়ে অন্য স্থানে আক্রমণ করে না । যেমন টেনেলা সিকামে, ব্রনেটি বৃহদন্তে এবং এসারভুলিনা ডিওডেনামে আক্রমণ করে । টেনেলা কখনই ডিওডেনামকে এবং এসারভু- লিনা সিকামকে আক্রমণ করে না ।

মুরগির রক্ত আমাশয়

বাহ্যিক লক্ষণ: মোরগ মুরগির ককসিডিওসিস রোগের প্রধান লক্ষণ আন্তিক প্রদাহ। রক্ত ও আম মিশ্রিত পায়খানা অথবা ডায়রিয়া দেখা যায় । পালক উষ্কো খুস্কো ও ঝুটি ফ্যাকাশে হয় । যেহেতু অন্তনালী প্রধান লক্ষ্যস্থল তাই আক্রান্ত মোরগ-মুরগি খাদ্য ও পানি কম খায় । খাদ্য হজম হয় না ফলে দৈহিক ওজন হ্রাস পায় , দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় । আক্রান্ত মোরগ-মুরগি এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে । আক্রান্ত মোরগ-মুরগির দেহ গোল হয়ে বলের আকার নেয় । সাব ক্লিনিক্যাল অবস্থায় ককসিডিওসিস হলে পেট ব্যথার কারণে আক্রান্ত মোরগ- মুরগি ঠোকরা ঠুকরি করে, অস্থির অবস্থা বিরাজ করে । সাধারণত আইমেরিয় টেনেলা খুবই ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত যা মোরগ-মুরগির সিকামে থাকে, রক্তক্ষরণ হয় এবং মৃত্যু হার বৃদ্ধি করে । অন্যান্য আইমেরিয়া প্রজাতিগুলো বেমি ক্ষতিকর না হলে ও অন্তের এপিথেলিয়াল কোষ ধ্বংস করে এবং পরবর্তীতে কলস্ট্রিডিয়াম নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে নেক্রোটিক এন্টারাইটিস নামক রোগ সৃষ্টি করে।

প্রতিরোধ:

খামারে মোরগ-মুরগির ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং প্রত্যেক খামারীকেই সে চেষ্টা করা উচিত । কারণ খামারে কক্রিডিওসিস রোগের প্রাদুর্ভাব হলে সে খামারে এ রোগের পুনরায় প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা থাকে । রক্ত আমাশয় বা কক্রিডিওসিস পুনরায় প্রতিরোধে সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । বদ্ধ খামারে পালিত মোরগ-মুরগিতে কক্রিডিওসিস নিয়ন্তণ করা খুবই কঠিন, কারণ ককসিডিয়ার ‘উসিস্ট’গুলো প্রচুর পরিমাণে খামারের সর্বত্র ছড়ানো থাকে এবং খুব সহজে বেশি পরিমাণ ‘উসিস্ট’ অন্য মোরগ-মুরগি খেয়ে ফেলে।

রক্ত আমাশয় বা কক্রিডিওসিস প্রতিরোধে নিচের ব্যবস্থাপনাগুলো মেনে চলা ভালো:

১। খামার ও পানির পাএ মোরগ-মুরগির পিঠ বরাবর রাখা, যেন খামার ও পানির পাত্র পায়খানার সংস্পর্শে না আসে ।
২। খাবার ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
৩। আক্রান্ত মোরগ- মুরগির বিষ্টা সরিয়ে ফেলা যেন সুস্থগুলো এ বিষ্টার সংস্পর্শে না আসে ।
৪। বাচ্চা মোরগ-মুরগির বয়স্কগুলো থেকে আলাদা রাখা কারণ বয়স্ক মোরগ-মুরগির রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে ।
৫। লিটার সবসময় শুষ্ক রাখা, মাঝে মাঝে ওলট-পালট করা এবং ভিজা লিটার সরিয়ে ফেলা ।
৬। খামারের জায়গার তুলনায় অধিক মুরগি পালন না করা ।
৭। পুষ্টির ঘাটতি হলে রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায় । এজন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । অতিরিক্ত প্রোটিনযুক্ত খাদ্য দেয়া যাবে না । পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ ও ‘কে’ সরবরাহ করতে হবে ।
৭। পুরাতন লিটার সম্পূর্ন ফেলে না দিয়ে ৫-১০% পুরাতন লিটার নতুন লিটারের সাথে মিশানো ।
৮। খাদ্য কক্রিডিওস্ট্যাট ব্যবহার করেন রক্ত আমাশয় নিয়ন্তণ করা যায় ।

লেখক: ডা. এএইচএম সাইদুল হক

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম