লোকসানে ব্যবসা গোটাচ্ছেন দিনাজপুরের অনেক পোলট্রি খামারি

248

দিনাজপুরে প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকায়। অর্থাৎ একটি ডিমের মূল্য ৯ টাকা। সেই ডিম খামারিদের কাছ থেকে আড়তদারেরা প্রতিটি ডিম কিনছেন সাড়ে ছয় টাকায়। খামারিরা বলছেন, সম্প্রতি পোলট্রি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় একটি ডিমের উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট টাকা। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ডিমে তাঁদের লোকসান হচ্ছে দুই টাকা। এ কারণে মুরগি বিক্রি করে দিচ্ছেন খামারের মালিকেরা। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন খামার সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার শ্রমিক।

দিনাজপুর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় লেয়ার মুরগির খামার ১৯৭টি, ব্রয়লার মুরগির ৮৯৩টি, সোনালি মুরগির খামার ৭৮৬টি। সব মিলিয়ে জেলায় পোলট্রি খামার রয়েছে ১ হাজার ৮৭৬টি। তবে খামারিদের হিসাবে, এ সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এসব খামারে সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে ১ লাখ পর্যন্ত মুরগি রয়েছে।

দিনাজপুর সদর, বিরল ও ঘোড়াঘাট উপজেলায় কয়েকটি খামার ঘুরে দেখা যায়, মাস তিনেক আগেও খামারিদের অনেক ব্যস্ততা ছিল। খামার ছিল মুরগিতে ভরা। পোলট্রি খাদ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে পুষিয়ে উঠতে না পেরে মুরগি কমিয়ে ফেলছেন খামারিরা। কেউবা পুঁজি হারানোর ভয়ে একেবারেই গুটিয়ে নিয়েছেন খামার।

এ অবস্থায় খাদ্যের চড়া দাম ও উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণ খুঁজছেন ছোট খামারিরা। তাঁরা বলছেন, সরকারি নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। তা ছাড়া তাঁদের কারণে বড় কোম্পানিগুলো ডিম ও মাংসের দাম বাড়াতে পারছে না। তাই কৌশলে পোলট্রি খাদ্য ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নিজেদের উৎপাদিত ডিম ও মুরগি কম দামে বিক্রি করছেন। মাঝখানে ছোট খামারিরা লোকসানে পড়ছেন।

দিনাজপুর সদর উপজেলার সবচেয়ে বড় লেয়ার খামারি আবদুল আজীজ। তিন মাস আগে তাঁর খামারে মুরগি ছিল ৪২ হাজার। বর্তমানে আছে ২৭ হাজার। তাঁর খামারে কাজ করেন ১৪ জন শ্রমিক। কাঁচামাল কিনে নিজেরাই খাবার (ফিড) তৈরি করেন। দৈনিক ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ কেজি ফিড ছাড়াও ভ্যাকসিন, শ্রমিকের মজুরি, বিদ্যুৎ বিলসহ খামারে খরচ ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। বিপরীতে প্রতিদিন ডিম পাচ্ছেন ২৪ হাজার থেকে ২৪ হাজার ৫০০টি। বুধবার প্রতিটি ডিম ৭ টাকা দরে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। হিসাব অনুযায়ী, লোকসান গুনেছেন ১৭ হাজার টাকা।

আবদুল আজীজ বলেন, ‘পোলট্রি খাবারের দাম বাড়ায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে লোকসান গুনছি। যে দোকান থেকে খাদ্যপণ্য কিনতাম, সেখানে ৪৫ লাখ টাকা বাকি পড়েছে। মাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা। এদিকে বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি ৯৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছি।’

বিরল উপজেলার খোজাপুর এলাকায় ২০১৪ সালে ৫ একর জমিতে ১০ হাজার মুরগি নিয়ে আলী পোলট্রি ফার্ম শুরু করেছিলেন মুস্তাহিদ আলী। পোলট্রি ফিডের দামের সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে মাসখানেক আগে ৬ হাজার মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে খামারে আছে ৪ হাজার হাইলাইন জাতের লেয়ার মুরগি।

মুস্তাহিদ আলী বলেন, তিন মাস আগে ভুট্টা কিনেছি প্রতি কেজি ২৩ টাকায়। সেই ভুট্টা বর্তমানে ৩৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ২ হাজার ২০০ টাকার সয়াবিনের বস্তা (৫০ কেজি) ৩ হাজার ২০০ টাকা, রাইস ব্র্যান ১ হাজার ২০০ টাকার জায়গায় ২ হাজার ৫০০ টাকা, লাইমস্টোন ৪০০ টাকার বস্তা এখন ৬০০ টাকা। ওষুধ ও ভ্যাকসিনের দামও বেড়েছে।

দিনাজপুর পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গঠনের আলোচনা চলছে জানিয়ে মুস্তাহিদ বলেন, দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসানের মুখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোলট্রি খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন গঠনের জন্য প্রায় মাসখানেক সময় ধরে অনেকের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড়াই শতাধিক খামারি বর্তমানে খামার বন্ধ করে দিয়েছে। পাঁচ শতাধিক খামারি তিনভাগের দুইভাগ মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই দোকান বা বেসরকারি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছেন।

বিরল উপজেলার কাজীপাড়ায় লিটন পোলট্রি খামারের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, এক হাজার মুরগি নিয়ে শুরু করা খামারে বর্তমানে দিনে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ। ৪-৫ মাস আগেও এ খরচ ৫ লাখের মধ্যে ছিল। তিনি বলেন, বিরল উপজেলায় দুই শতাধিক খামার আছে। সব মিলিয়ে নতুন করে মুরগি তুলেছেন সর্বোচ্চ ২০ জন।

পোলট্রি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে দিনাজপুরের গৃহলক্ষ্মী পোলট্রি ফিডের স্বত্ত্বাধিকারী মনিরুজ্জামান বলেন, আন্তজার্তিক বাজারে সয়াবিনের খৈলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।

এ বিষয়ে কথা হয় দিনাজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাধারণত গরু ও ছাগলের খামারিরা আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসেন। মুরগির খামারিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কম। জেলায় সম্প্রতি পোলট্রি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজে থেকে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। সরকার পোলট্রি শিল্প নিয়ে ভাবছে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি নীতিমালা হবে।’
সূত্র: প্রথম আলো

ফার্মসএন্ডফার্মার/০৯এপ্রিল ২০২২